ইতিহাস বলে, হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) মহানবীর (সা.) প্রিয় দৌহিত্রই ছিলেন না শুধু, ছিলেন তার আদর্শের প্রতীকও। আর সে জন্যই তিনি ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করেননি। বরং তার স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে প্রমাণ করে গেছেন ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’। অর্থাৎ প্রয়োজনে জীবন দেব, শহীদ হব; কিন্তু কোনো অযোগ্যের কাছে বা অনৈসলামিক নেতৃত্বের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করব না। তিনি ইসলামের জন্য সপরিবারে জীবন উৎসর্গ করে বিশ্ব মুসলিমকে শিখিয়ে গেছেন, অত্যাচারী যেই হোক আর যত শক্তিশালী হোক, তার কাছে মাথানত করা চলবে না।
অথচ কিছু নামধারী মুসলমান এই শাশ্বত চেতনাকে মিথ্যা প্রমাণ করার হীন চেষ্টায় বলে থাকে, হজরত হুসাইনের (রা.) এ সিদ্ধান্ত নাকি ভুল ছিল। তিনি ক্ষমতার জন্যই নাকি কুফায় গিয়েছিলেন। আর তার এই যাওয়াই নাকি ইসলামের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ এই শোহাদায়ে কারবালা ছিল দীনের জন্য রক্ষাকবচ। তাই যারা এ সত্যকে মিথ্যা বলে ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায়, নিঃসন্দেহে তারা ইয়াজিদের দোসর। এ কথা স্পষ্ট যে, ইমাম হুসাইনের (রা.) এ পদক্ষেপ ছিল মহান আল্লাহতায়ালারই নির্দেশিত। আল্লাহতায়ালা কি পবিত্র কোরআনে বলেননি- ‘তোমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে।’ (সূরা আল ইমরান : ১১০)
ইমাম হুসাইন (রা.) তো এই বিধানেরই বাস্তবায়ন করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চরিত্রহীন ইয়াজিদ যখন ক্ষমতার জোরে সত্য-ন্যায়ের মসনদে চেপে বসেছিল, তখন সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল অনাচারের বিষবাষ্পে। ইয়াজিদ ভুলে গিয়েছিল তাকওয়া-তাহারাত। খোদাভীতি ও ইবাদত। সে খোদার বিধানকে তোয়াক্কা না করে লিপ্ত হয়েছিল বেগানা নারীগমনে। অসহায়দের সেবার পরিবর্তে সে খুলেছিল আমোদ-প্রমোদের দুয়ার। তার এসব কার্যকলাপে কুফার লোকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে ইমাম হুসাইনের (রা.) কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানালো যে, তারা মুসলিম জাহানের ইমাম হিসেবে ইয়াজিদকে নয়, হজরত হুসাইনকেই (রা.) চায়। তাদের চিঠি পেয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) কুফার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে (রা.) পাঠালেন। হজরত মুসলিম (রা.) কুফায় এসে দেখলেন ঘটনা সত্য। এখানকার অধিকাংশ লোকই হজরত হুসাইনকে (রা.) খলিফা হিসেবে চাচ্ছেন। তিনি ইমাম হুসাইনকে (রা.) দ্রুত সেই সংবাদ জানিয়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে অনেকেই হজরত মুসলিমের (রা.) হাতে ইমাম হুসাইনের (রা.) পক্ষে বায়াত হতে শুরু করেন। মুনাফিক মারফত এ খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলে সে কুফার গভর্নর নোমান বিন বাশিরকে (যিনি হজরত মুসলিমের পক্ষে ছিলেন) বরখাস্ত করে তার জায়গায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসাল। আর বলে দিল, ‘তুমি বসরারও গভর্নর, পাশাপাশি কুফারও গভর্নর। অতএব, তুমি মুসলিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করো।’ ইবনে যিয়াদ ছিল ক্ষমতালোভী ও কঠোর প্রকৃতির লোক। সে কুফায় এসেই মুসলিমের (রা.) হাতে বায়াত হওয়া অনুসারীদের থেকে নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতার করা শুরু করে। এ অবস্থায় হজরত মুসলিম (রা.) সবার সঙ্গে পরামর্শ করে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। সেদিন অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি ইশারা দিলেই গভর্নর ভবন ধূলিসাৎ হয়ে যেত।
অবস্থা বেগতিক দেখে চতুর যিয়াদ ফন্দি করে বন্দিদের বলে যে, তোমরা গভর্নর ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে বলো, তারা যদি ঘেরাও প্রত্যাহার না করে তবে তোমাদের জবাই করে হত্যা করা হবে। বন্দিরা প্রাণ বাঁচাতে তা-ই করল। তাদের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হজরত মুসলিমের (রা.) হাতে বাইয়াত হওয়া ৪০ হাজার অনুসারী আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকারে তলাতে লাগল। আর সুযোগ পেয়ে ইবনে যিয়াদ সত্যের বাহক হজরত মুসলিমকে (রা.) গ্রেফতার করে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করে ফেলল।
হায়রে কুফাবাসী! কী নিকৃষ্টতম ছিল তাদের সেদিনের বিশ্বাসঘাতকতা! তাদের মুনাফেকির কারণেই রচিত হল কারবালা ইতিহাসের রক্তিম অধ্যায়।
এদিকে হজরত হুসাইন (রা.) তার স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ প্রায় ৭৩-৭৪ জনের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা শরিফ থেকে কুফার দিকে রওনা হন। মাঝপথে এসে চাচাতো ভাই মুসলিমের (রা.) শহীদ হওয়ার সংবাদ পেলেন। কিন্তু তিনি যে ভীরু নন। তিনি তো আসাদুল্লাহিল গালিব, আলী ইবনে আবী তালিবের রক্ত। মহানবীর (সা.) আদর্শের রক্ষাকবচ। তাই তিনি ভয়ে পিছপা হলেন না। বরং বীরবিক্রমে সামনে অগ্রসর হলেন। অতঃপর কুফা থেকে দু’মঞ্জিল দূরে কারবালা প্রান্তরে তাঁবু টানালেন। অসত্যের মূলোৎপাটনে সত্যের তলোয়ার ধরলেন।
ইয়াজিদ বাহিনীর মাথা কেটে কেটে লাশের স্তূপ বানিয়ে দিলেন। অপর দিকে শত্রুরা তার পবিত্র বদনে বৃষ্টির মতো তীর-বর্শা নিক্ষেপ করতে থাকে। আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তে রঞ্জিত হলেন। একসময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঘোড়া থেকে জমিনে পড়ে গেলেন। তখন নির্দয় সিমারের নির্দেশে জাহান্নামি সেনা ইবনে আনাস নখয়ী হজরত ইমাম হুসাইনের (রা.) মাথা মোবারক শরীর মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।
আহা! কী হৃদয়বিদারক ছিল ইমাম হুসাইনের (রা.) সেই শাহাদত!
সেদিন যদি ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিতেন, তাহলে তাকে জীবন দিতে হতো না। পিপাসায় কাতর হয়ে মারা যেত না দুধের শিশুগুলোও। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-
‘গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা
আম্মা গো! পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি, মা!’
সেদিন ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিলে হয়তো তিনি ও তার পরিবার বেঁচে যেতেন। কিন্তু মহানবীর (সা.) দাঁত ভেঙে যাওয়ার বিনিময়ে পাওয়া দীনের কী হতো? সেদিন যদি তিনি নীরবে সব মেনে নিতেন, তাহলে এই তেরশ’ বছর পর এসে আমরা মহানবীর (সা.) রেখে যাওয়া এই অক্ষুণ্ণ দীনকে পেতাম কি? বহু আগেই তার কবর হয়ে যেত। আর পরবর্তী সময়ে দুঃশাসকদের ব্যাপারে আমরাও হতাম নীরব সমর্থক। কেননা তখন তো আর আমাদের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের (রা.) দৃষ্টান্ত থাকত না। থাকত না মাথা উঁচু করার সাহস। দহনে দহনে অঙ্গার হয়ে গেলেও আমাদের মনোভাব হতো, এটাই বুঝি অখণ্ডিত তকদির!
কিন্তু হজরত হুসাইন (রা.) তা হতে দেননি। তিনি বিশ্ব মুসলিমের জন্য এই শিক্ষাই রেখে গেলেন যে, অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তির অন্ধ আনুগত্য চলবে না। নীরবচারী হওয়া যাবে না। বরং পুরো পৃথিবীও যদি অসত্যের পক্ষ নেয়, তবুও কিছু লোকের এমন হওয়া চাই যে, এ মিথ্যার মোকাবেলায় তারা পরোয়াহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটাই ছিল মুসলিম জাহানের ইমাম হজরত হুসাইনের (রা.) কারবালার শিক্ষা। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, বিশ্ব মুসলিম আজ ইমাম হুসাইনের (রা.) এ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আর সে জন্যই আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে দেখছি মুসলিমদের হাহাকার। শুনছি দীর্ঘ নিঃশ্বাস। মরুভূমির সেই কারবালারই নমুনা দেখছি এখন নাফ নদীর তীরে আরকান রাজ্যে।
আমিনুল ইসলাম হুসাইনী : প্রাবন্ধিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন