দেড় হাজার বছর আগে হেরা পর্বতের গুহায় যে নুর নাজিল হয়েছিল, অল্প সময়ের মধ্যেই তার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। মুহাম্মদ (স) ইসলাম প্রচার শুরু করার পর যারা এই নতুন জীবন বিধান মেনে নিয়েছিলেন, তারাও আর স্থির থাকেননি- মানবতার কল্যাণে অন্যদেরও এই বিধান গ্রহণের আহ্বান জানাতে থাকেন। আরব ভূখণ্ড থেকে কুরআনের আহ্বান ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত, চীন, পারস্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রতিটি প্রান্তে।
ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে যেসব দেশে এর দাওয়াত পৌঁছেছিল, চীন তার একটি। ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, মূলত মুহাম্মদ (স)-এর সাহাবী সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রা) নেতৃত্বে সাহাবীদের একটি দল প্রথম চীনে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন ৬১৫ থেকে ৬১৮ খিস্টাব্দের মধ্যে। এই দলে ছিলেন মুহাম্মদ (স)-এর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবি তালিব (রা) এবং আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের (রা) মতো সাহাবীরা। কোনো কোনো বর্ণনায় কায়েস আবনে হুজায়ফা (রা), উরওয়াহ ইবনে আসাসা (রা) ও আবু কায়েস ইবনে হারেসের (রা) নামও এসেছে।
সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ছিলেন রাসুল (স)-এর মামা। অর্থাৎ, তার মা আমিনার চাচাতো ভাই। এর বাইরে এই সাহাবীর আরো বড় একটি মর্যাদা রয়েছে- তিনি দুনিয়াতে থাকতে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবীর একজন, যাদের ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শুধু তাই নয়, তিনি প্রখ্যাত মুসলিম জেনারেলদের একজন।
ঐতিহাসিক গবেষণা অনুসারে, আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) থেকে সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম, আসামের কামরূপ ও মণিপুর হয়ে চীনের ক্যান্টন পৌঁছেছিলেন সাহাবীদের দলটি। পরে তারা ফিরে যান। এরপর আবার দ্বিতীয়বার একই উদ্দেশ্যে চীন আসেন সা’দ (রা)। ৬৫০-৫১ খিস্টাব্দে তিনি তৃতীয়বার এই দেশে আসেন। তবে এবার এসেছিলেন সরকারি দায়িত্ব নিয়ে। সময়টা ছিল খলিফা উসমানের (রা) শাসনামল। সা’দকে (রা) ইসলামি খেলাফতের রাষ্ট্রদূত করে চীনে পাঠানো হয়েছিল এবং তৎকালীন চীন সরকারও তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামপূর্ব চীনের দক্ষিণ উপকূলে বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করতেন আরব বণিকরা। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস দেশটিতে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসার পর আর আরবে ফিরে যাননি। তার সমাধিও হয়েছে চীনে। দেশটির ক্যান্টনে আছে তার নির্মিত হুয়াইশেং মসজিদ। এটিকে ‘লাইট হাউস মসজিদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইতিহাসবিদদের একটি অংশ মনে করেন, এ সময় তাঙ সাম্রাজ্যের সম্রাট গাওজং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আস্তে আস্তে চীনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ইসলাম। এক পর্যায়ে ইসলাম দেশটির রাষ্ট্রীয় ধর্মের একটি হয়ে ওঠে।
এরপর ধীরে ধীরে আরো বিভিন্নভাবে ইসলাম প্রচার হয়েছে চীনে। মুসলিমরা পারস্য ও মধ্যএশিয়া জয় করার পর সেখান থেকে প্রশাসক, সেনা জেনারেল ও অন্য নেতাদের পাঠানো হতো দেশটিতে। চীনে ইসলাম প্রচারের আরো ব্যাপক সূচনা ঘটে বনু উমাইয়ার সময়কালে। এ সময় চীনাদের সঙ্গে আরবীয়দের কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। পরে যখন চীনা সম্রাট সোয়ানসোংকে জনৈক ষড়যন্ত্রকারী সিংহাসনচ্যুত করেন, তখন তার পুত্র তৎকালীন খলিফা মানসুর আব্বাসীর কাছে সাহায্য চান। খলিফা তার সাহায্যে চার হাজার সৈন্য পাঠান ও সোয়ানসোংকে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন।
এ সৈন্যরা চীনেই বিয়েশাদি করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ও ইসলাম প্রচার শুরু করেন। এর ৬০০ বছর পর আরো একটি ইসলাম প্রচারক দল চীনে আগমন করে। এরা ছিলেন আরব, ইরান ও তুরস্কের নাগরিক। হিজরি সপ্তম শতকে মঙ্গোলীয় আক্রমণের শিকার হয়ে এরা চীনে অবস্থান করেন। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উত্তর ও পশ্চিম চীনে ইসলাম প্রসার লাভ করে। ১৩ শতকে মার্কোপলোর বর্ণনায় দেখা যায়, সারা ইউনান প্রদেশ মুসলিম হয়ে গেছে। ১৪ শতকে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘তালিফোর সব অধিবাসী মুসলিম।’ ইবনে বতুতার মতে, ‘প্রায় সব শহরেই মুসলিম মহল্লা বিদ্যমান।’ ১৭ শতকের শুরুতে চীনা ইহুদিদের একটি বিরাট দল মুসলিম হয়ে যায়। এরপর থেকে ইসলামের প্রসার আর রোধ করা সম্ভব হয়নি।
তবে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর চীনে আর ভালো নেই ইসলাম। শুরু থেকে ইসলামের সঙ্গে চীনের যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সেখান থেকে দূরে সরে গেছে দেশটি। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে নানাভাবে দমন করা হয়েছে মুসলিমদের। ‘সমাজতন্ত্রবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে অনেক মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে, বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির ‘রেড গার্ড’ বাহিনী। বর্তমানে চীনে মুসলিম নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ, পুরুষের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ, রমজানে রোজা রাখা নিষিদ্ধ। সর্বশেষ ইসলামি নাম রাখাও নিষিদ্ধ করেছে চীনা প্রশাসন।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন