শেখ সামসুন্নাহার ইতি: আমি তখন ইস্কুলে পড়ি, একবার, আমার বড় বোনের বিয়ের জন্য পাত্র পক্ষ এলো, তো ছেলের বোন বলছে, ” মেয়ে তো শ্যামলা , অসুবিধা নাই, আমার ভাই ফর্সা , আমাদের বাড়ীতে কোন কাল মেয়ে নাই…এই আরকি “।
আমার নানী পাশের ঘর থেকে শুনে ফেললেন। আর কই যাবে। সাথে সাথে আমার আব্বাকে তলব করা হলো। নানী বললেন , ” আমার বাড়ীর মেয়েকে যে কুর্নিশ করে, রানী করে নিবে সেই পাবে। এতো বড় সাহস আমার বাড়ী বসে , আমার নাতনীর গায়ের রঙ নিয়ে কথা !!! মেয়ে তো দিবই না । এই অশিক্ষিত দের এক্ষুনি বিদায় করো ” !!!
নানী এতটাই রেগে গেলেন যে ডাকলেন , হনুফা (আমাদের বাসায় থাকতো , আমাদের দেখাশুনা করতো), ঝাড়ুটা নিয়ে আয়, এই গুলি কে ঝাড়ু মেড়ে বিদায় কর।
নানীর খুব বংশের দাপট ছিল, কারন নানীর বড় ভাই ( আমাদের বড় নানা), ডঃ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ” রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর । আর নানীর বাবা (আমাদের বড় বাবা) ছিলেন, ” কিশোর গঞ্জের শোলাকিয়া ঈদ্গাহ ময়দানের ঈমাম সাহেব। ১৯৭১ সালে নানী তার ৫ ছেলেকেই দেশের জন্য যুদ্ধে পাঠান । শুধু তাই না, নানী নিজে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন, নানীর সাধ্য মতো। শুধু তাই না , গ্রামের আচার-বিচার এ নানীর মতামত খুব গুরুত্ব পেত। তিনি পর্দা করতেন কিন্তু, গ্রাম চলতো তার কথায়। ছোট খাট শ্যামাঙ্গিনী নানীর বুদ্ধি আর ক্ষমতার কোন ঘাটতি ছিল না। সেই নানীর নাতনীর গায়ের রঙ নিয়ে কথা… রাগে নানীর ভয়াবহ অবস্থা ।
বলাই বাহুল্য, আমার মা – বাবা , খুব ভদ্রভাবে অতিথিদের বাড়ী থেকে তাড়ালেন । যদিও , আমার বোন তখন কিছুতেই বিয়েতে রাজী ছিলোনা। কারন সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল, খুব ভাল ছাত্রী ছিল বলে স্কলারশিপেই পড়ত।
আপা দেখতে আমার চোখে অপূর্ব , আর খুবি তেজী …। এখনো আমার সাহস আর শক্তির আধার। আপা , আমার নানীজানের মতোই প্রতাপের সাথে সবাইকে নিয়ে ভাল আছেন। আমার দুলাভাই , প্রায় দুই বছর সাধনা করে, আপাকে পান।
এতো কথা বলার কারন টা হচ্ছে, গতকাল রাত থেকে আমারও ” হনুফা” কে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে… । হনুফা , প্লীজ, একটা ঝাড়ু আন, এনে এই সমাজের কীটগুলোকে বের করে দে , এই সমাজ থেকে … আমাদের সমাজে ওদের কোন জায়গা নাই ।
গতকাল আমার খুব প্রিয় এক ছোট বোন তার জীবনের দুঃখের কথা লেখে তার ওয়ালে। তার অনুমতি নিয়েই কিছু টা আমি এখানে দিচ্ছিঃ
” আমি নিজে কালো হওয়াতে মনের মধ্যে একটা হীনমন্যতা কাজ করে ছোট বেলা থেকেই। যে কারনে একমাত্র মেয়ে হয়েও আমি আহ্লাদী হই নি। আবার, ফেসভ্যালু বলে একটা ব্যাপার আসলেই আছে যা আমার অভিজ্ঞতায় বলে। ভাবি, হয়তো আমি সুন্দর হলে জীবনটা আমার আজ এত একাকীত্বে গ্রাস করতো না( সংসারটা হারাতে হতো না) , …জীবনের যেসব ইন্টারভিউতে বাদ পরেছিলাম, তাও হতে পারতো! ইত্যাদি ইত্যাদি!
শ্বশুর বাড়ির কথা আজ নাই বললাম, শুধু এটুকু না বললেই নয়, কালো রঙ টা আমার এতই মন কষ্টের কারন, যে আমার যখন সিজারিয়ান করে ছেলে হোল, আমার অর্ধাংশ তখন জ্ঞান ছিল, অর্ধাংশ অবশ! সে অবস্থায়, ডাক্তার যখন আমাকে ছেলে কেমন হয়েছে দেখাল, তখন আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘‘ও কালো হয় নি তো?’’ কতটা মনঃকষ্ট থাকলে, অমানবিক ভাবে আমি… ছেলেটা সুস্থভাবে জন্মাল কিনা সে খবর না জেনে, তার রঙ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম!
মানুষের সব সপ্ন,চাওয়া,পাওয়া অনেক সময় চিরস্থায়ী হয় না; বড় হতে হতে আজ আমার ছেলেটা রোদে জ্বলে কালো হয়ে যাচ্ছে কেমন করে যেন! এখন ওর দাদী (যারা তাদের ছেলে কে আরেক বিয়ে করিয়ে , সেই নতুন বউ-সংসার নিয়ে দিব্যি ভাল আছে !!!) বলেন, নাতি আমার ছেলের মতন ফরসা জন্মালেও এখন মায়ের মতন কালো হয়ে গেছে! … এখন শুধু আমার ছেলের সুস্থ ও স্বাভাবিক একটা জীবনের আশা, আর বাদ বাকী স্বপ্ন! আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সারের কথা মনে হল, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় হয়! কি জানি শেষে কি হয়, জীবন তো সবে তার শুরু… সঙ্গী শুধু আধ পাগল এই মা! “-
যেই মেয়েটা পুতুল নিয়ে রাজপুত্র রাজকুমারী খেলার কথা সেই মেয়ে কি ভয়ংকর ভাবে ছোটবেলা থেকে হীনমন্যতা নিয়ে বড় হয়েছে। এটা একটা মানুষ কে সামাজিক ভাবে হত্যা করা ছাড়া আর কি ??? আমার জানামতে, এই ছোট বোনটা অত্যন্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে । কিন্তু, তারপরেও সে মুক্তি পায়নি কালো রঙের হাত থেকে !
কেন ??
কে দিয়েছে এই সমাজকে সে অধিকার, যে নারীকে গায়ের রঙ, চুলের ঘনত্ব , নাক উঁচা না বুচা, মেয়ে মোটা না শুকনা, লম্বা না খাট এই সব দিয়ে যাচাই করার সিনেমার নায়িকা হতে গেলে যদি পরিচালকের ছাঁচে গড়া রূপের দরকার হয় , তবে সেটাও সেই নায়িকা কি করবে, তার ব্যাক্তিগত পছন্দ ।
কিন্তু, বাস্তবের জীবনটা তো সিনেমা না। একটা মেয়ের গায়ের রঙ বা তার দৈহিক বিষয় কেন হবে তার পরিচয়ের বা যোগ্যতার মাপ কাঠি ??? প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা আছে তার নিজের মতো করে বাঁচার । কিন্তু, কোন আধিকার বলে নারী কে এই সমস্ত দৈহিক রূপের কাঠামোতে বিচার করা হবে, আর বানানো হবে সংসারের বলির পাঠা ???
আমি বলবো এই ছোট বোনটা যে ফেসবুকে তার ওয়াল এ সত্যটা জানিয়ে পোস্ট দিল, সে অসীম সাহসী। আমাদের সমাজের সবাই কে বারবার করে মনে করিয়ে দিতে হবে যে , নারী কে চিতায় চড়ানোর যুগ আর নেই। এই ভাবে শত শত বছর ধরে কোটি কোটি নারী এই বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে । পৃথিবী যখন এগিয়ে যাচ্ছে আমরা তখন খুব সুচারু ভাবে আমাদের মেয়েদের মানসিকভাবে ভেঙ্গেচুড়ে দিচ্ছি ছোটবেলা থেকেই… আবার শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার দেয়া রুপের দোষে নারীর সংসারও কেরে নেওয়া হচ্ছে ! ইউনিভার্সিটির মেয়ে থেকে শুরু করে অশিক্ষিত মেয়েটাও বাদ যায় না। গায়ের রঙ কালো তাই বেশী যৌতুক দিতে হবে, না দিতে পারলে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ও আছে অথচ, এটা সম্পূর্ণ ভাবে Verbal Abuse, সামাজিক নির্যাতন। এটা সম্পূর্ণ ভাবে , আইনগত ভাবে পশ্চিমের দেশ গুলো তে নিষিদ্ধ । আমার দেশে ও চিরতরে নিষিদ্ধ হোক ।
নারী তুমি সবার আগে তোমাকে ভালবাস। যে দিন তুমি তোমাকে ভালবাসবে, তোমাকে নিয়ে অহংকারের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে, এই সব সামাজিক কীট গুলো কে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাবে, সে দিনই ওরা ভয় পাবে। তোমাকে নিয়ে কথা বলার সাহস পাবে না। আমার দেশের মেয়েরা আত্মবিশ্বাস , আর সাহস নিয়ে জীবন কে জয় করুক। জীবনের জয় হোক। ( নতুন দেশ )
পাঠক মন্তব্য
মেয়েরা কি করবে এখানে!!না তারা গায়ের রঙ পাল্টাতে পারবে না পারবে কাউকে জোর করতে যে,"আমাকেই বিয়ে করো"।বরং এই সমাজকে পাল্টাতে হবে।সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে হবে।ইসলাম ধর্মে কোথাও বিয়ে করার ক্ষেত্রে পাত্রীর রূপকে তার গুণ & দ্বীনের উপরে বিবেচনা করার কথা বলা হয়নি,কোনোকিছু পছন্দ না হলে তাকে তৎক্ষণাৎ তালাক দেয়ার কথাও বলা হয়নি।তাহলে,এই যে এসব ফর্সা মেয়ে খোঁজাখুঁজির সংস্কৃতি তা কোত্থেকে কেন কবে উদ্ভব হয়েছে আল্লাহই জানেন!!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন