নানা নাটকীয়তার পর ১৩ই অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এর আগে টানা ১২ দিন বিনিদ্র রাত কেটেছে গণমাধ্যমকর্মীদের। ২রা অক্টোবর দুপুরে গুঞ্জন শুরু হয় ছুটি থেকে ফিরে পুনরায় লম্বা ছুটিতে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। সময় গড়াতেই গুঞ্জন হয় সত্যি। জানা যায়, এক মাসের ছুটি চেয়ে প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখেছেন তিনি। এরপর ‘ছুটি’ ইস্যু প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই নতুন মোড় নিতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়- অসুস্থতাজনিত কারণে প্রধান বিচারপতি ছুটি চেয়েছেন। গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে আসে প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষরিত একটি চিঠি। তাতে ছুটি ভোগের কারণ হিসেবে উল্লেখ ছিল ‘অসুস্থতা’। প্রধান বিচারপতির অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার তুলে দেয়া হয় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার ওপর। এরপর থেকেই এস কে সিনহা অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন- এমন খবরে মুখর হয়ে উঠে গণমাধ্যম। শুরু হয় প্রধান বিচারপতির ১৯ হেয়ার রোডের বাসাকে ঘিরে মিডিয়াকর্মীদের আনাগোনা, উৎসুক জনতার ভিড় ও গোয়েন্দাদের নজরদারি। প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনের দু’টি ফটক। একটি পূর্বদিকে (সার্কিট হাউজ রোডে) আরেকটি পশ্চিমদিকে (কাকরাইল মসজিদের উল্টো পাশে)। মিডিয়াকর্মী ও গোয়েন্দাদের সতর্ক চোখ- এই দু’টি ফটককে ঘিরে। বাসায় কেউ প্রবেশ করলেই তার পরিচয় জানার চেষ্টা। কখন তিনি বের হচ্ছেন- তা নিয়ে উৎসুক্য।
২রা অক্টোবর বিকালে সুপ্রিম কোর্ট বারের কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি জয়নুল আবেদিন ও মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কমিটির নেতারা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে যান। তবে অসুস্থতার কথা বলে তিনি তাদের দেখা দিতে রাজি হননি। পরে বাসার নিরাপত্তা কর্মীদের মাধ্যমে জানিয়ে দেন, তার পক্ষে বার নেতাদের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব না। অনেকটা হতাশা নিয়ে ফিরে যান বার নেতারা।
৪ঠা অক্টোবর বুধবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জি প্রধান বিচারপতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের কোর্ট অফিসার আলমগীর হোসেন পাসপোর্ট নিয়ে প্রধান বিচারপতির বাসায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পর সকাল সাড়ে ১১টায় তিনি অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসে ভিসার আবেদন করতে যান। সেখানে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করার পর দুপুর তিনটায় তিনি বাসায় ফেরেন। বিকাল ৪টায় প্রধান বিচারপতির বাসায় প্রবেশ করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। প্রায় ৪০ মিনিট প্রধান বিচারপতির বাসায় অবস্থান করেন তিনি। পরে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রীকে বিদায় জানান এস কে সিনহা। এর কিছুক্ষণ পর প্রধান বিচারপতি বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যান। সেখানে লক্ষ্মী পূজা সেরে মন্দিরের অফিস কক্ষে মন্দির কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ও সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করেন। বিকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি আবার বাসায় ফিরে আসেন। এর পরপরই বাসায় প্রবেশ করেন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ রিডার মাহবুব হোসেন। ২০ মিনিট পর বের হয়ে যাওয়ার সময় তিনি জানান, প্রধান বিচারপতির ব্যাংক হিসাবের কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলেন। তবে প্রধান বিচারপতি সুস্থ আছেন বলে তিনি দেখেছেন।
পরের দিন ৬ই অক্টোবর শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে প্রধান বিচারপতির ছোট ভাই রবীন্দ্র কুমার সিনহা তার বাসায় প্রবেশ করেন। সাড়ে নয়টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলাম যান। ১১টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গহওর রিজভী প্রধান বিচারপতির বাসায় যান। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর তিনি বের হওয়ার সময় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা না বলেই চলে যান। সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ ১২টার দিকে হেয়ার রোডের বাসায় প্রবেশ করেন। ওই দিন বিকালে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সম্পাদকসহ কমিটির ১৪ সদস্যের একটি টিম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে আসার পথে তাদেরকে মৎস্য ভবনের সামনে পুলিশ ও গোয়েন্দারা আটকে দেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাসার সামনে সুপ্রিম কোর্ট বারের সহ-সভাপতি উম্মে সালমা কুলসুম এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
৭ই অক্টোবর দুপুর ১২টায় সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ফারজানা ইয়াসমিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনি বিকাল ৫টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এর আগে সকালে প্রধান বিচারপতির ভাগ্নি সীমা সিনহা প্রবেশ করেন। দুপুরে নারিন্দার গৌড়ি মঠ থেকে প্রসাদ নিয়ে আসেন মন্দিরের গাড়িচালক সুজন ও সন্ন্যাসী সুদর্শন দাস ব্রম্মাচারী। দুপুর তিনটায় সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি বিকাল ৪টার দিকে বের হয়ে যান। বিকাল ৫টায় গুলশান থেকে আসেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যবসায়ী বন্ধু আতিক চৌধুরী। রাত সাড়ে নয়টার পর তিনি প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে বের হন। ওই দিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক সজলকৃষ্ণ ব্যানার্জি প্রধান বিচারপতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান।
৮ই অক্টোবর ভোরে প্রধান বিচারপতি মহাখালীস্থ আইসিডিডিআর,বি’তে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে আসেন। সেখানকার ইনফরমেশন ডেক্সের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, তিনি সেখানে ডায়াগনোসিসের কাজে গেছেন। কয়েকটি পরীক্ষা করে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। তারপর দুপুরে তার সরকারি বাসভবনে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম সালেক। প্রধান বিচারপতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দুপুর দেড়টার দিকে তিনি চলে যান। সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ হেয়ার রোডের বাসায় প্রবেশ করেন।
৯ই অক্টোবর সকাল ১১টায় তিনি দাঁতের ডাক্তার দেখাতে বনানীর জনসন প্যালেস ক্লিনিকে যান। সেখানে জেনারেল ডেন্টিস সেনফোর্ড সরকারের কাছে চিকিৎসা করিয়ে দুপুর ২টায় বাসায় ফিরেন। বিকালে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ রিডার মাহবুব হোসেন ও অনীল হায়দার প্রধান বিচারপতির বাসায় প্রবেশ করেন। তারা ৫টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যান। তার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান।
১০ই অক্টোবর দুুপুরে অধ্যাপক সজলকৃষ্ণ ব্যানার্জি প্রধান বিচারপতির স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে যান। ১১ই অক্টোবর দুপুর ১২টায় প্রধান বিচারপতির বাসায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ধানমন্ডি থেকে আসেন তার বন্ধু মনজুর রহমান। আধা ঘণ্টা তিনি সেখানে অবস্থান করে বের হয়ে যান। তার কিছুক্ষণ পর প্রবেশ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম সালেক। প্রধান বিচারপতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তিনি বের হয়ে যান। দুপুর তিনটায় সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ রিডার মাহবুব হোসেন ও সন্ধ্যায় অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ এবং রাত ৮টায় শ্যালিকা কৃষ্ণা সিনহা দেখা করে যান। পাশাপাশি সন্ধ্যা ৬টায় সাবেক বিচারপতি আব্দুর রশিদ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। এরপর অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী ও বেঞ্চ রিডার মাহবুব হোসেন দেখা করেন।
১৩ই অক্টোবর বিকালে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে ১৪ই অক্টোবর প্রধান বিচারপতি রওয়ানা হবেন- এমন তথ্য সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ওই দিন সকাল ৬টায় প্রধান বিচারপতি বাসা থেকে বের হয়ে রাজধানীর স্বামীবাগে ইসকন মন্দিরে পূজা দিতে যান। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করে তিনি সকাল ৭টায় বাসায় ফিরেন। দুপুর ১২টায় সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ রিডার মাহবুব হোসেন এস কে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। দুপুর ২টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সজলকৃষ্ণ ব্যানার্জি প্রধান বিচারপতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) সাব্বির ফয়েজ ও ৭টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভবানি প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। ১৪ই অক্টোবর সকাল থেকেই সবার দৃষ্টি ছিল প্রধান বিচারপতির হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনের দিকে। গণমাধ্যম ঘটা করে প্রচার করে- সেদিনই বিদেশ যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। বিদেশযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকেই প্রধান বিচারপতির বাসায় ভিড় করেন আত্মীয়স্বজনরা।
দেখা করতে আসেন প্রধান বিচারপতির ভাই ড. এন কে সিনহা, শ্যালিকা শীলা সিনহা ও তার মেয়ে সীমা সিনহা, ভাতিঝি জামাই রাজমনো সিংহ, সুজিত সিংহ, রামকান্ত সিংহসহ আরো অনেকে। ওই দিন সকাল থেকে প্রধান বিচারপতির বাসার দুই ফটকেই ভিড় বেড়ে যায় মিডিয়াকর্মী ও উৎসুক জনতার। বেড়ে যায় গোয়েন্দা নজরদারিও। সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় পুলিশ প্রটোকলের দুইটি গাড়ি প্রবেশ করে। সন্ধ্যা ৭টার পরে সুপ্রিম কোর্টের কোর্ট কিপার ওয়ারেস আলী খান ও বেঞ্চ রিডার মাহবুব হোসেন এবং অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ প্রবেশ করেন। প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকে সবাই। কখন বের হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। যদিও আগে থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের শুক্রবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার টিকিট কাটা ছিল। রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে দুই গাড়ি পুলিশ প্রটোকলসহ তার গাড়িটি বাড়ির পশ্চিম পাশের ফটকে এসে দাঁড়ায়। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেন। সেখানে আগে থেকে ভিড় করেন দেশের প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকস ও অনলাইন মিডিয়াকর্মীরা।
নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে হঠাৎ করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ান প্রধান বিচারপতি। গাড়ি থেকে নামার পরই তিনি মিডিয়াকর্মীদেরকে বলেন, আমি অসুস্থ না। আমি ভালো আছি। আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসবো। আমি একটু বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগ যাতে কোনোভাবে কলুষিত না হয় এই কারণে আমি সাময়িক ভাবে যাচ্ছি। আমার কারো প্রতি কোনো বিরাগ নাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকারকে ভুল বুঝানো হয়েছে রায়কে কেন্দ্র করে। এই আমার বক্তব্য আপনাদের কাছে দিয়ে গেলাম বলে তিনি চলে যান।
মানবজমিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন