কামরুল হাসান শাকিম: র্যাগিং শব্দের অনেক আভিধানিক অর্থ থাকলেও মূলত আমরা র্যাগিং অর্থ বুঝি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের প্রথম পরিচিত হবার প্রথা । বাংলাদেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় , মেডিক্যাল কলেজ , কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু কলেজে এই র্যাগিং প্রথা চালু আছে ।
র্যাগিং টা বিশেষ করে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষাকালীন সময়ে বা নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হবার পর পুরাতন শিক্ষার্থীদের কর্তৃক নতুন শিক্ষার্থীরা এর শিকার হয়ে থাকে । ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে । র্যাগিং যেন আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে ।
র্যাগিং এর প্রচলন গ্রিক সংস্কৃতিতে সপ্তম ও অষ্টম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট বাড়াতে অর্থাৎ ইতিবাচক কারনে প্রথম শুরু হয়। ষাটের দশক থেকে এই উপমহাদেশে র্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।প্রথম দিকে এটা শুধুমাত্র সিনিয়র-জুনিয়রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হলেও নব্বইয়ের দশকে এটি ভয়াবহ রূপ ধারন করে ।
র্যাগিং নবীন এবং পুরাতন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করার কথা বললেও বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিং এর নামে চলে অসহনীয় নির্যাতন । ভর্তি পরিক্ষার আগের রাত থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় হল ও মেস গুলোতে চলে এই র্যাগিং । ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা এমনিতেই দূর-দুরান্ত থেকে আসার কারনে ক্লান্ত এবং পরীক্ষার কারনে মানসিকভাবে চিন্তাগ্রস্থ থাকে । ভর্তিচ্ছুরা বিশেষ করে মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা র্যাগিং সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকায় , ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে র্যাগিং এর নামে নির্যাতনের ফলে মানসিক ভাবে ঘাবড়ে যায় ।
তাছাড়া এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারনা জন্মে । পরীক্ষা না দিয়েই চলে যাওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে । তারপর ভর্তি পরীক্ষার দিন, ভর্তির দিন এবং যারা চান্স পায় তারা প্রথম কয়েকমাস ক্যাম্পাসে হাটাচলা দেখলেই র্যাগ দেয়ায় পটু সিনিয়রা বুঝে নেয় এরা নতুন । তারপর শুরু হয় র্যাগিং । র্যাগিং এর ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সহ কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ।
র্যাগিং নামে বর্বরতা নোংরামিতেই ভরা বেশী । অশ্লীল কথাবার্তা বলা ,অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী প্রদর্শন তাছাড়া পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যদের জড়িয়ে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার, সবার সামনে পুরোপুরি নগ্ন করে নাচানো, সবার সম্মুখে চরম অশ্লীল বই পড়তে বাধ্য করা, সবার সামনে যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, পেস্ট খেতে বাধ্য করা, সবার সামনে পর্নো দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা, রাতে মশার কামড় খাওয়ানোর জন্য বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে উঠবস, বুকডন, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, প্রকাশ্যে কোনো মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, শীতের মধ্যে পানিতে নামানো ও ফুটবল খেলতে বাধ্য করা, শীতের রাতে সিনিয়রদের কাজে বাইরে পাঠানো, সিগারেট, গাঁজা, মদ পানে বাধ্য করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম, মাঠের মাপ নেয়া ইত্যাদি ।
র্যাগিং নিয়ে বাংলাদেশে সুনির্দষ্ট কোন আইন না থাকলেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা কিছু নিয়ম কানুন আছে । র্যাগিং এর শিকার হলে শিক্ষার্থীদের প্রশাসন বরাবর অভিযোগ করার কথা উল্লেখ আছে । কিন্ত র্যাগিং এ শিকার শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করতে ভয় পায় কারন প্রশাসন অপরাধীকে সাময়িক শাস্তি দিলেও সব সময় নিরাপত্তা দিতে অক্ষম ।
ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় তাঁদের সাথেই থাকতে হবে এজন্য রায়গিং এর শিকার হলেও অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে চায় না । তবে বর্তমানে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং এর বিরুদ্ধে জোড়ালোভাবে পদক্ষেপ নেয়ায় মাঝেমধ্যে এসব অপরাধীদের শাস্তিস্বরূপ স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের খবর পাওয়া যায় ।
যারা র্যাগিং এর সাথে জড়িত তারা আসলে বিকৃত মানসিক রোগে আক্রান্ত । নির্যাতন করে আনন্দ পাওয়া নৈতিকতা, মূল্যবোধ বিবর্জিত অসুস্থ মানসিকতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না । র্যাগিং নামক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকলের সোচ্চার হওয়া এবং সরকারের উচিত কঠোর আইন প্রণয়ন করে এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা ।
কামরুল হাসান শাকিম
শিক্ষার্থী , নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন