ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক

আজ ২৩ শে অক্টোবর অধ্যাপক গোলাম আযমের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। আজকের এই দিনে কারারুদ্ধ অবস্থায় তিনি বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ৯০ বছর বয়সে যখন তিনি মৃত্যুবরন করেন তখন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইবুনাল তাঁকে ৯০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল। ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারী তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি হলে তিনি আদালতে হাজির হন। ট্রাইবুনাল তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করেন। সরকার তাঁকে সেখান থেকে বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সেখানে তাঁকে আমি বেশ কয়েকবার দেখতে যাই।

হাসপাতালে অবস্থানকালীন দিনগুলোতে তাঁকে আমার সবসময় প্রশান্তচিত্ত ও সুস্থির মনে হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই ট্রাইবুনাল যখন তাঁকে পাঁচটি অভিযোগে অভিযুক্ত করে ৯০ বছরের কারাদন্ড দেয় তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন-‘তারা কি চায় আমি আরো ৯০ বছর বেঁচে এ কারাদন্ডের মেয়াদ পূর্ণ করি’!

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে আমি ছিলাম তাঁর প্রধান কৌশলী। আমাকে সহযোগিতা করার জন্য দেশে এবং লন্ডনে শক্তিশালী দুটি লিগ্যাল টিম কাজ করে যাচ্ছিল।

২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত ছিল যে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। বিচারকার্য শুরু কালে ডিফেন্স কাউন্সেল হিসাবে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে তাও প্রায় নিশ্চিত। উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ডিফেন্ড কাউনসেল এর ভুমিকা পালন করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সবকিছু বিবেচনা করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য তৈরী হলাম। ১৯৭৩ সালেরআন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। কিন্তু সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে এই আইনকে বৈধতা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনকে সংবিধান পরিপন্থি প্রমান করতে হলে সর্বপ্রথম সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে হবে।

এসব সূক্ষ সাংবিধানিক বিষয়াদির বিশ্লেষনের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদদের লিখিত মতামত প্রয়োজন। প্রথম দ্বারস্থ হলাম ইংলিশ বারের জ্যৈষ্ট ব্যারিস্টার মাইকেল বেলফ কিউসি’র কাছে। মাইকেল ১৯৯২ সালে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় আমাদের বিদেশী আইনজীবি ছিলেন। তার মতামত পেলাম আমাদের পক্ষে। তারপর ভারতের একজন সেরা আইনজীবি এবং প্রাক্তন এটর্নী জেনারেল সলী সোরাবজীর মতামত নিলাম। তার মতামতও আমাদের অনুকুলে এল।

ঢাকায় তখন জাতিসংঘের যিনি প্রতিনিধি ছিলেন তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বেশ ঘনিষ্ট। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠিত হবার পূর্বে আওয়ামীলীগের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা চাওয়া হয়। জাতিসংঘের মনোভাব বুঝার জন্য ২০০৯ সালের জুন মাসে আমি জেনেভা গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম জাতিসংঘের তথকালীন মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নেবী পিলে বাংলাদেশ সরকারকে একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন: ১৯৭৩ সালের আইন আন্তর্জাতিক মানদন্ডের নীচে। আমি এ চিঠির কপি চাইলাম। ডেস্ক অফিসার আমাকে তা সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। আরও জানতে পারলাম এই আইনের আওতায় বিচার হলে আন্তর্জাতিক মহলে অনেক হৈ চৈ হবে।

বিচারের এক পর্যায়ে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করলাম। দুদিন শুনানী হল। আমাদের পক্ষে অনেক ভাল ভাল নজীর এবং সাংবিধানিক যুক্তি ছিল। শুনানী শেষে হাইকোর্টের জ্যৈষ্ট বিচারপতি আমাকে প্রশ্ন করলেন: ‘মি: রাজ্জাক, একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কয়বার হয়?’ এটা কোন সাংবিধানিক প্রশ্ন ছিল না। কোর্টের মনোভাব বুঝতে কোন অসুবিধা হল না। আমরা রিট পিটিশন প্রত্যাহার করলাম। দেশের সামগ্রিক পরিবেশ জামায়াত নেতৃবৃন্দের অনুকুলে ছিল না। উত্তপ্ত ও প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে এবং অনেক উস্কানীর মুখে আমরা ঠান্ডা মাথায় আদালতের বাইরে ও ভিতরে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। বিশেষ করে বিভিন্ন দিক থেকে আমি খূব চাপের মধ্যে ছিলাম। অনেক হয়রানীরও শিকার হয়েছি।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সিংহভাগ অভিযোগ ছিল তিনি বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেছেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহীনির নিন্দা করেছেন। তাঁর অবস্থান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে।

১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় পড়ে তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ উত্থাপন করতে পারেনি। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ১৯৭২ সালের দালাল আইনের অধীনে পড়ে। কিন্তু দালাল আইনে তাঁর বিচার হচ্ছে না, বিচার হচ্ছে মানবতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জন্য। সুতরাং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তিনি দন্ডিত হতে পারেন না, যদিও ট্রাইবুনাল আমার এ সকল বক্তব্য গ্রহন করেনি। শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হল। ট্রাইবুনাল অধ্যাপক গোলাম আযমকে দোষী সাব্যস্থ করে ৯০ বছরের কারাদন্ড দিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপীল করলেন। কিন্তু আপীলের শুনানী হবার আগেই তিনি ইন্তেকাল করলেন।

অধ্যাপক গোলাম আযমের একটি বর্ণাঢ্য জীবন ছিল। ১৯৪৬-৪৭ সেশনে তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের সাধারন সম্পাদক এবং ১৯৪৭Ñ৪৮ ও ১৯৪৮Ñ৪৯ সেশনে তিনি ডাকসুর নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তিনি তৎকালীন তমদ্দুন মজলিশের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। ডাকসুর সাধারন সম্পাদক থাকা অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের তৎকালীনপ্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সামনে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা প্রদানের জন্য মানপত্র পেশ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ১৯৫২ সালের ৬ মার্চ গ্রেফতার হন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট ( পিডিএম) গঠিত হলে তিনি পিডিএম এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের গনআন্দোলনের সময় ডেমোক্রেটিক একশান কমিটি (ডিএসি) গঠিত হলে সেখানে তার ভুমিকা ছিল সক্রিয়। একই বছর মার্চ মাসে অনুষ্টিত গোল টেবিল বৈঠকেও তিনি যোগদান করেন। সুতরাং সংগত কারনেই তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অংশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল।

কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সমর্থন করা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। তাঁর আত্মজীবনী পড়লে জানা যায়: এ সিদ্ধান্ত গ্রহনে তার সমসাময়িক তিন রাজনীতিবিদ পূর্ব বাংলার প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিন, মুসলিম লীগ নেতা খাজা খায়ের উদ্দিন, এবং নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মৌলবী ফরিদ আহমদ তাকে যথেষ্ঠ প্রভাবিত করেছিলেন। ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তিনি এবং এই তিন নেতা জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাত করেন। এই সাক্ষাতই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহীনিকে সমর্থনে তার প্রথম পদক্ষেপ। তার আত্মজীবনী থেকে আরো জানা যায়, ঐ রাজনৈতিক সংকটের জন্য তিনি ইয়াহইয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সম্পূর্ণরুপে দায়ী করেন। তাছাড়া ভারতীয় আধিপত্যবাধের ভয়ও তাঁর ছিল। এবং সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে সাধারন জনগনকে বাঁচানোর জন্য ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে তিনি অনেক কার্যকরী ভুমিকা পালন করেছেন (জীবনে যা দেখলাম তৃতীয় খন্ড পৃষ্টা ১৩৭-১৪৫)। কিন্তু ২৫ মার্চেরসামরিক হস্তক্ষেপের মত বিরাট এবং সুদূর প্রসারী ফলাফল বহনকারী ঘটনার প্রেক্ষাপটে তাঁর ঐ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। তাছাড়া অনেক অনুসন্ধানের পর আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, এতবড় একটি সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে জামায়াতের মজলিশে শুরার কোন পূর্ব অনুমোদন ছিল না বা এজন্য তাঁকে কোন এখতিয়ারও দেয়া হয়নি। টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাত করা এবং পরবর্তীতে রেডিওতে তার ভাষায় ‘একটি দায়সারা গোছের’ ভাষন দেয়ার পূর্বে ঢাকায় যাদের সাথে তিনি পরামর্শ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের মজলিশে শূরার উর্দুভাষী সদস্য।

বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বৈঠকে এই মতামত প্রকাশ করা হয় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট রাজনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তান দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। শুধূ তাই নয় অধ্যাপক আযমের নিজস্ব প্রস্তাবের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করে যে, ’পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের সাথে যুক্ত থাকবে না পৃথক হবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ এখতিয়ার’ পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের (জীবনে যা দেখলাম ৩য় খন্ড, প্রকাশকাল জানুয়ারী ২০০২,পৃষ্টা ১১৭-১১৯)। এ তথ্য আমি সর্বপ্রথম জানতে পারি ১৯৭৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের প্রথম আমীর মাওলানা আব্দুর রহীমের নিকট থেকে। এ থেকে বোঝা যায় পাকিস্তানের অখন্ডতার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক ছিলনা।

এই রাজনৈতিক বিবেচনায় ১লা মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ভুমিকা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে। ১০ মার্চ ১৯৭১ সালে তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি ছাপা হয়। তখন অধ্যাপক গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর। বিবৃতিতে তিনি অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান। বিবৃতিটি আমরা ১৯৯২ সালে তাঁর নাগরিকত্ব মামলায় এবং ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আদালতে দাখিল করি। কিন্তু ২৫ মার্চের আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর অধ্যাপক গোলাম আযম এর রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।

কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল না তা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আব্দুল কাদের মোল্লা আমার সাথে ব্যক্তিগত আলোচনায় স্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে জামায়াতের তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ইউএনবি’র সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন: “১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সিদ্ধান্ত আবেগ নির্ভর ছিল- বস্তুনিষ্ঠ ছিল না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভুল হতেই পারে।”

১৯৭১ সালের ৩ রা ডিসেম্বর অধ্যাপক গোলাম আযম পি আই এর একটি বিমান যোগে করাচী থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা হন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার ফলে তার বিমান ঢাকায় অবতরনে ব্যর্থ হয়ে জেদ্দায় আশ্রয় গ্রহন করে। যুদ্ধ শেষে তিনি পাকিস্তানে চলে যান এবং ১৯৭২ সালের শেষ নাগাদ হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদী আরবে এসে তিনি আর কখনও পাকিস্তানে ফিরে যাননি। জনাব নূরুল আমীন এবং জনাব মাহমুদ আলী বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহন করেন এবং বাংলাদেশে ফেরার চিন্তাও করেননি। জনাব খাঁজা খায়েরউদ্দিন বাংলাদেশের জেল থেকে বেরিয়ে লন্ডন হয়ে পাকিস্তানে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরন করেন। পাকিস্তান সমর্থক রাজনৈতিক বন্ধুদের মত অধ্যাপক গোলাম আযমও ইচ্ছে করলে পাকিস্তানে থেকে যেতে পারতেন অথবা বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। জন্মভূমিকে ভালবাসতেন বলেই তিনি পাকিস্তানী পাসপোর্টে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ এসেছিলেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত তার জন্য কোন সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। তিনি অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়েছিলেন। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ৩৬ বছর তিনি বাংলাদেশে কাটিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি এমন কথা বলেননি বা কোন কাজ করেননি যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। তার আত্মজীবনী পড়লে বুঝা যায় তিনি তাঁর জন্মভুমিকে ভালবাসতেন। কিন্তু তিনি যদি ১৯৭১ সালে তাঁর ভুমিকা সম্পর্কে জাতির সামনে সঠিক সময়ে একটি গ্রহনযোগ্য বক্তব্য দিতে পারতেন তাহলে ইতিহাস হয়ত ভিন্ন হত। ১৯৯৪ সালের ২৪শে জুন সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে তাঁর নাগরিকত্ব ফিরে পাবার পর বায়তুল মোকাররমের এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘অতীতে যদি কোন ভুল ত্রুটি করে থাকি মাফ করে দিবেন।’ এর মাধ্যমে তিনি তাঁর ১৯৭১ সালে সামরিক হস্তক্ষেপের সমর্থনের কথাই বুঝিয়ে থাকবেন। কিন্তু এতবড় একটা ইস্যুকে একটি বক্তব্যের মাধ্যমে সমাধান করার প্রচেষ্টা কেউ গ্রহন করেছেন বলে জানা যায়নি ।এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধূরী তার ’রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ের ২৮৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন: “অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর ভুল স্বীকার করেননি। বলেছেন, যদি ভূল করে থাকি তাহলে তিনি দুঃখিত, অনুতপ্ত হওয়ার কথা বলেননি ”।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করা তাঁর নিজের জন্য বা তাঁর দলের জন্য কল্যানকর হয়নি। ১৯৭২ সালে তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়। দীর্ঘ ২২ বছর পর ১৯৯৪ সালে তিনি নাগরিকত্ব ফিরে পান। ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন তারই চিন্তার ফসল। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, ১৯৮৭ সালে জামায়াতে ইসলামীই সর্বপ্রথম তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। তখন তিনি ছিলেন জামায়াতের আমীর। যদিও পরবর্তীতে অনেকেই এর কৃতিত্ব দাবী করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ভুমিকার ফলে তিনি এবং তার দল বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারায় স্থান পায়নি। মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ এর শত্রুরাও স্বীকার করেন যে তারা দুজন যোগ্য মন্ত্রী ছিলেন। দূর্নীতির সাথে তাদের দূরতম কোন সম্পর্কও ছিল না। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাদেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে প্রাণ দিতে হল। ( যদিও আইনজীবি হিসাবে আামি মনে করি তারা নির্দোষ ছিলেন )

জামায়াতের বর্তমান জনশক্তি এবং নেতৃত্বের প্রায় ৯৫ ভাগ একাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম। ১৯৮১ সালে বা ১৯৯১ সালে যে শিশুর জন্ম শিবির বা জামায়াত করার কারনে তাকেও আজ রাজাকার বলে গালি দেয়া হচ্ছে। ১৯৭১ সালের বোঝা তাকেও বহন করতে হচ্ছে। অথচ জামায়াতে ইসলামী আদর্শেরভিত্তিতে গঠিত একটি গণতান্ত্রিক দল;নীতি নৈতিকতা ভিত্তিক, দূর্নীতিমুক্ত রাজনীতিতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৯৭১ সালের ভুলের এ বোঝা বহন করতে না হলে বাংলাদেশে জামায়াত হয়ত আজ তুরস্ক ও মরোক্কোর ক্ষমতাসীন একে পার্টি এবং জাস্টিস এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি অথবা তিউনিসিয়ার রাশীদ আল ঘানুসীর নেতৃত্বাধীন প্রভাবশালী আন নাহদা পার্টির ভুমিকা পালন করতে পারত।

অধ্যাপক গোলাম আযম একজন সৎ, সদালাপী, এবং হাস্যেজ্বল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রায় ৩০ বছর জামায়াতের আমীর ছিলেন। সংগঠন পরিচালনায় তিনি সবসময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিচয় দিয়েছেন এবং কোন সময় সংগঠনের আভ্যন্তরীন বিষয়ে কোন ধরনের ‘রাজনৈতিক’ কূট কৌশলের আশ্রয় গ্রহন করেননি। তাঁর ভিতর ও বাইরের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। ১৯৭৩ সাল থেকে দীর্ঘ ৪১ বছর আমি তাকে খুব নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি । তাঁর সাথে কিছু কিছু বিষয়ে আমার মতপার্থক্য থাকলেও আমি সারাজীবন ছিলাম তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত কারাগারে মৃত্যুবরন করলেও তাঁর জানাযায় স্মরনকালের বৃহত্তম জনসমাগম হয়েছিল। আজকের এই দিনে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখকঃ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি