মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
রামসাগর। নাম শুনে অনেকে সাগর ভেবে ভুল করতে পারেন। নাম রামসাগর হলেও কিন্তু সাগর নয়। আমারও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। দিনাজপুর এর আগেও কয়েকবার সংক্ষিপ্ত সফরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের অভাবে দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখা হয়নি। এবার সে সুযোগ করে দিলেন আমাদের প্রিয় নেতা শওকত মাহমুদ। দিনাজপুরের সাংবাদিক মোফাস্সেলুল মাজেদকে নিয়ে শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র রামসাগরে পৌঁছে যাই আজ সকালে।
কৌতুহল থেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা। রামসাগর হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দীঘি এবং জাতীয় উদ্যান। দিনাজপুর সদর উপজেলার তাজপুর গ্রামে অবস্থিত । ১৯৬০ সালে রামসাগরকে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে নেয়া হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে রামসাগরকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল রামসাগরকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সব কাজ হয়েছে সাবেক মন্ত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশীদ জাহান হকের প্রচেষ্টায়।
রামসাগর মানুষের খনন করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দীঘি। পাড়সহ রামসাগরের আয়তন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২ বর্গমিটার, দীঘির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩১ মিটার ও প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। রামসাগর দিঘির গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। দীঘির পশ্চিম পাড়ে মধ্যখানে একটি সুবিশাল ও মনোরম ঘাট ছিল যার কিছু অবশিষ্ট এখনো রয়েছে।
দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ রামসাগর দীঘি খনন করেন। রামনাথ ছিলেন দিনাজপুর রাজবংশের শ্রেষ্ঠতম রাজা। তিনি ১৭২২ সাল থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরে রাজত্ব করেন। দিনাজপুর রাজবংশের ইতিহাসের মতে, ১৭৫০ থেকে ১৭৫৫ সালের মধ্যে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে রামসাগর দীঘি খনন করা হয়। দীঘিটি খনন করতে তৎকালীন প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং ১৫ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। বিখ্যাত রামসাগর দীঘি আজও রাজা রামনাথের অন্যতম অতুল্য কীর্তি হয়ে আছে দেশ-বিদেশে।
রামসাগর দীঘি নিয়ে প্রচলিত রয়েছে মজার লোককাহিনী। এই অঞ্চলে প্রাণনাথ নামে এক রাজা ছিলেন। সুশাসক ও প্রজাপ্রিয় রাজা বলে তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি ছিল, আর ছিল অফুরন্ত ধনসম্পদ। তৎকালে দেশজুড়ে নেমে আসে প্রকৃতির নিষ্ঠুর তাণ্ডব। শুরু হয় একটানা অনাবৃষ্টি ও খরা। গোটা মৌসুমে একফোঁটা পানিও পড়ল না আকাশ থেকে। অনাবাদি রইল মাঠ। ফসল বা শস্য পাওয়া গেল না একমুঠো। দেশজুড়ে দেখা দিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। অনাহারে মরে শত শত মানুষ। জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হলো রাজভাণ্ডার। এতে খাদ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও দেখা দিল পানীয়জলের অভাব। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি ও খরায় খাল-বিল, দিঘি-নালা শুকিয়ে খাঁ খাঁ। একফোঁটা পানি নেই কোথাও। রাজ্যজুড়ে শুরু হলো পানির জন্য আহাজারি। এমন পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন এক বিরাট দীঘি খনন করার। শুরু হলো দিঘি খনন। হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে খনন করে এক বিশাল দীঘি। কিন্তু এত গভীর করে খনন করা সত্ত্বেও দীঘির বুকে এলো না একফোঁটা পানি। হতাশা ও দুর্ভাবনায় বৃদ্ধ রাজা আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন। তাঁর মৃত্যুর আশঙ্কায় ঘরে ঘরে শুরু হলো কান্নার রোল।
একদিন রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন, তাঁর একমাত্র পুত্র রামকে দীঘিতে বলি দিলেই পানি উঠবে। রাজার মুখে স্বপ্নাদেশ শুনে সারা রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। কিন্তু রাজপুত্র রামের মনে কোনো বিকার নেই। নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রজাদের জীবন রক্ষা করতে রাজকুমার অবিচল। রাজার নির্দেশক্রমে দীঘির মধ্যস্থলে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করা হলো। এরপর গ্রামে গ্রামে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রজাদের জানিয়ে দেওয়া হলো, কাল ভোরে দীঘির বুকে পানি উঠবে।
পরদিন ভোর না হতেই রাজবাড়ির সিংহদ্বার খুলে গেল। বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া। হাতির পিঠে চড়ে সাদা কাপড় পরে যুবরাজ যাত্রা শুরু করলেন সেই দীঘির দিকে। যুবরাজ রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দিঘির তলদেশ হতে অজস্র ধারায় পানি উঠতে লাগল। চোখের পলকে পানিতে ভরে গেল বিশাল দিঘি। পানিতে ভেসে রইল রাজকুমারের সোনার মুকুট। যুবরাজ রামের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে দীঘির নাম রাখা হলো রামসাগর।
আরো একটা লোককাহিনী শোনা যায়। রাজা রামনাথের দিঘি খনন করার পর পানি না উঠলে রাজা স্বপ্ন দেখেন দীঘিতে কেউ প্রাণ বিসর্জন করলে পানি উঠবে। তখন স্থানীয় রাম নামের এক যুবক দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দিলে রাজার নির্দেশেই সেই যুবকের নামে দীঘির নাম রাখা হয় রামসাগর।
রামসাগরের স্থির, স্বচ্ছ সাগরের মতো নীল জলরাশি দেখলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। মূল দিঘির চারপাশে জুড়েই রয়েছে প্রশস্ত পাকা রাস্তা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দিঘির সৌন্দর্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য উপভোগ করা সত্যিই বিস্ময়কর। পুরো রামসাগর পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। তবে দর্শনার্থীরা চাইলে ভ্যান বা রিকশা ভাড়া করেও ঘুরতে পারেন, আর সঙ্গে গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই। গাড়িতে বসেই আপনি দিব্যি রামসাগরের সৌন্দর্য দেখতে পারবেন। রামসাগর জাতীয় উদ্যানের পাকা রাস্তার এক পাশে রামসাগর দিঘির নীল স্বচ্ছ টলমলে জলের হাতছানি আর এক পাশে উঁচু উঁচু টিলার নয়নাভিরাম সবুজের সমারোহ। টিলাজুড়ে নানা জাতের গাছগাছালি। গাছগুলোতে পাখিদের আড্ডা আর কলকাকলিতে রামসাগরে সব সময়ই উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। শীতকালে রামসাগর দিঘির জলে হাজার হাজার জলজ অতিথি পাখির খুনসুটিতে তৈরি হয় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
রামসাগর জাতীয় উদ্যানে আছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা। সেখানে আছে বানর, অজগর আর বেশ কিছু হরিণ। শিশুদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন পশু-পাখির মূর্তি দিয়ে গড়া একটি শিশুপার্ক। আছে সাতটি পিকনিক কর্নার।
পাঠক মন্তব্য
আমার শহরে
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন