ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক
আজ ২১শে নভেম্বর। আজকের এই দিনে ২ বছর আগে গভীর রাতে ফাঁসির কাষ্ঠে জীবন দেন ৬৮ বৎসর বয়স্ক জামায়াত ইসলামীর তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ।
তার ছিল একটি সহজ সরল সাধাসিধা জীবন। আন্দলন আর সংগ্রাম, সংগ্রাম আর আন্দোলন ছিল তার ২৪ ঘন্টার চিন্তা, ভাবনা, কল্পনা। প্রত্েযক মানুষেরই সীমাবদ্ধতা থাকে, তিনিও সীমাবদ্ধতার উর্ধে ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন দ্বীন কায়েমের এক একনিষ্ঠ সৈনিক। দ্বীনের কাজের ব্যাপারে তার কোন ক্লান্তি ছিলনা কোন অবসাদ ছিলনা। দিনের পর দিন একই পাজামা পান্জাবী পরে, একই সেন্ডেল পরে জেলার পর জেলা, শহরের পর শহর সফর করেছেন। ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক সভাপতি, ঢাকা ও মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর এসিসটেন্ট সেক্রেটারী জেনারেল এবং সবশেষে জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালনে তিনি সবসময়ই নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন।
আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জামায়াত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে অন্যন্য দলের সাথে লিয়াঁজো করার প্রধান দায়িত্ব ছিল তার উপরে। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশে আমি আইন পেশা শুরু করি ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম সাহেবের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য, আমি প্রথমে মুজাহিদ ভাইকে তার বাসায় নিয়ে যাই। এর পর থেকে তিনি অনেকটা নিয়মিত ভাবে আমিরুল ইসলাম সাহেবের মতিঝিলের চেম্বারে আসতেন। ১৯৮৮ সালে সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হওয়ার পর নিজামী ভাইও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বারের স্বনামধন্য আইনজীবী ব্যারিষ্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ এবং মুজাহিদ ভাই এরশাদ আমলের শেষ দিকে একসাথে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে জেলে ছিলেন। সেই সুবাদে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদের সাথেও তার ভাল পরিচয় ছিল। ১৯৮৯ সালে ড. কামাল হোসেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি নির্বাচিত হলে, তিনি তাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কামাল সাহেব নিজেই আমাকে একথা বলেছিলেন। তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট বারের অনেক নামকরা আইনজীবীদের সাথে তার ব্যাক্তিগত পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে মুজাহিদ ভাই রাজনীতিবিদ সহ দেশের সুশীল সমাজের অসংখ্য লোকের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে, আন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ পদত্যাগের ঘোষনা দেন। দেশে তখন অনেকটা অনিশ্চিত অবস্থা। আমরা সকলে মগবাজারস্থ সেন্ট্রাল অফিসে বসে যে যতটুকু পারছি কোথায় কি ঘটছে তার খোঁজ খবর নিচ্ছি। আমি প্রাক্তন বিচারপতি এবং সিনিয়র আইনজীবীদের কাছথেকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব খোঁজ খবর নিচ্ছি। তখন তিনি জামায়াতের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী জেনারেল। আমাদের এ তৎপরতা দেখে তিনি খুব আনন্দিত হলেন। বললেন, ১৫ বছর আগে দেশ যখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখনো আমরা অফিসে বসে খোজ খবর নেয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু সমাজের এত উচুঁ পর্যায়ের লোকদের সাথে তখন আমাদের যোগাযোগ ছিল না। ৫ই ডিসেম্বর রাতে বিষয়টি নিশ্চিত হল যে, শেষ পর্যন্ত এরশাদ সরকার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজী হয়েছেন। প্রধান বিচারপতির সাথে আমার ইতিপূর্বেই ব্যাক্তিগত যোগাযোগ ছিল। যতটুকু মনে পড়ছে নিজামী ভাই আমাকে বললেন, বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের বাসায় যেয়ে তার সাথে কথা বলার জন্য। দুএক জনকে সাথে নিয়ে যখন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাওয়ার জন্য তৈরী হলাম, হাসতে হাসতে মুজাহিদ ভাই বললেন, দেখবেন আবার মন্ত্রী (উপদেষ্টা) হয়ে ফিরে না আসেন। আমিও তাকে হাসতে হাসতে বললাম, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি এর কোন সম্ভাবনা নেই।
১৯৮৬ সালেই তিনি সর্বপ্রথম তার নিজস্ব এলাকা ফরিদপুর শহর থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। নির্বাচন ছিল এরশাদ সাহেবের সামরিক শাষনের অধীনে ব্যাপক কারচুপির নির্বাচন। ঐ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে মুজাহিদ ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দী ছিলেন মহব্বতজান চৌধুরী। ঐ নির্বাচনে জামায়াতের ১০জন সদস্য নির্বাচিত হলেও মুজাহিদ ভাই নির্বাচিত হতে পারেননি। মহব্বতজান চৌধুরীর নির্বাচনকে চ্যালেন্জ করে তিনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। আমরা সকলেই এই মামলার ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু তার আগ্রহে কোন ভাটা দেখিনি। সুতরাং তার আইনজীবী হিসাবে আমি এ মামলাটা দায়ের করেছিলাম। তারপর ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও তিনি অংশগ্রহন করেছিলেন কিন্তু কৃতকার্যতা লাভ করতে পারেননি। পরপর ৩ টি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরেও তার মধ্েয কোন ধরনের হতাশা আমি দেখিনি। তার মনোবল আগের মতই অটুট ছিল। ৪দলীয় ঐক্যজোটের স্বার্থ রক্ষার জন্য ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহন করেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদে এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল যে তিনি যেন সাতক্ষীরার জামায়াতের শক্তিশালী কোন একটি আসন থেকে নির্বাচন করেন। কিন্তু এই সুবিধা গ্রহন করতে তিনি মোটেই রাজী হননি। যদিও ফরিদপুরের চাইতে সাতক্ষীরার কোন একটি আসনে তার পাশ করার সম্ভাবনা অনেক বেশী ছিল।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। এটা তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয় ছিলনা। কিন্তু তার নিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে মন্ত্রালয়ের কাজকে তিনি অনেকটা গুছিয়ে আনতে পেরেছিলেন। তার শত্রুরাও এ স্বীকৃতি দিয়েছে যে, তিনি যোগ্যতার সাথে মন্ত্রনালয় পরিচালনা করেছেন এবং তার মন্ত্রনালয় ছিল সম্পূর্ন দূর্নীতিমুক্ত।
১৯৮১ সালে তিনি প্রথম লন্ডন সফরে আসেন যুবকদের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে। তখন আমি ইংল্যান্ডের যুব ইসলামী সংগঠনের ন্যাশনাল ইয়ুথ অর্গানাইজার। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন থেকে একটু দূরে ব্রাইটন শহরে। তিনি প্রায় ২ সপ্তাহ লন্ডনে ছিলেন। পুরা সময়টাই আমার বাসায় কাটিয়েছেন। এই সময় তাকে খুব নিকট থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। লন্ডন ইসলামী আন্দোলনের সবাই তার এই সফরে তার প্রতি খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি যেদিন বাংলাদেশে ফিরে গেলেন, সেদিন একটি মজার ঘটনা ঘটল। পাসপোর্ট ছাড়াই তিনি হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌছলেন। টিকেট কাউন্টারে যেয়ে তার স্বরন হল তিনি পাসপোর্ট আনেননি। তাকে বিমান বন্দরে রেখে, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে আমার স্ট্রাটফোর্ডের বাসা থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে কোন রকমে তাকে প্লেন ধরাতে সক্ষম হই।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি আর দেশের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ পান নি। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে আমাকে সরকার দেশের বাহিরে যেতে বাঁধা প্রদান করে। এনিয়ে পাল্টা পাল্টি অনেক মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়ে আমাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করে। একবার আমাদের ২জনেরই একসাথে বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোন কারনে সেই সফর বাতিল হয়। তার পর তিনি একবার বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যার্থ হন। তারপর আমি যতবারই বিদেশে যেতাম, অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে বলতেন “আমাদের ভাগ্েযকি আর আপনার মত বিদেশ যাওয়া আছে?”
অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় প্রথমে আইনজীবীদের সাথে লিয়াজোঁ করার দায়িত্ব ছিল, জামায়াতের বর্তমান সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের উপর। এই মামলায় সিনিয়র আইনজীবী নিয়োগে আমরা সমস্যায় পড়ে যাই। আমি তখন জুনিয়র আইনজীবী। শেষ পর্যন্ত কুমিল্লার এডভোকেট মুজিবুর রহমান সাহেব এবং ব্যারিষ্টার কোরবান আলী সাহেবকে নিয়ে আমরা মামলা দায়ের করি। যেকোন কারনেই হোক আইনজীবীদের মধ্েয সম্পর্কটা ভাল ছিলনা। এতে করে মামলা পরিচালনায় আমরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলাম। অত:পর সংগঠনের পক্ষ থেকে মুজাহিদ ভাইকে আইনজীবীদের সাথে লিয়াজোঁ করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
আমার যতটুকু মনে পড়ছে ব্যারিষ্টার এ, আর ইউসুফকে এই মামলায় সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি রাজী করিয়েছিলেন। ব্যারিষ্টার ইউসূফ সাহেব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। হাইকোর্টে ও সুপ্রিম কোর্টে অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলা মাঝে মধ্েয বিরতি দিয়ে প্রায় ২ বছর চলে। মামলা চলাকালীন সময়ে প্রতিদিনই মুজাহিদ ভাই সকালে কোর্টে আসতেন আর বিকালে আমাদের সাথে কোর্ট থেকে বের হয়ে যেতেন। আবার প্রায় প্রতিদিন সন্ধায় ব্যারিষ্টার ইউসুফের চেম্বারে আসতেন। ইউসুফ সাহেব অত্যান্ত নিষ্ঠার সাথে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করলেও অধ্যাপক গোলাম আজমের সাথে তার ব্যাক্তিগত সম্পর্কের কারনে প্রথমত কোন ফি গ্রহন করতে রাজী হননি। এনিয়ে মুজাহিদ ভাই এবং আমি বেশ চিন্তায় পড়লাম। ইতমধ্েয মামলা পরিচালনার কয়েক মাস চলে গেছে। তারপর একদিন আমি মুজাহিদ ভাইকে পরামর্শ দিলাম আপনি ইউসূফ সাহেবের নামে একটি পে অর্ডার করে একটি খামে ঢুকিয়ে তার হাতে তুলে দিন। তিনি তাই করলেন। এবার ইউসূফ সাহেব ফী গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানালেন না। দুদিন পরে মুজাহিদ ভাই আমার ধানমন্ডির বাসায় আসলেন খামে ভর্তি করে একটি পে অর্ডার নিয়ে। আমি খামটি না খুলে তার হাতে ফেরত দিলাম এই বলে যে, আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন থেকে গোলাম আযম সাহেবের সাথে আমার একটি ব্যাক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে, সুতরাং তার মামলায় আমি কোন ফি নিতে পারবনা। বিষয়টি নিয়ে তিনি খুব বেশি পীড়াপীড়ি করেন নি। শেষ পর্যন্ত যেদিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পেলেন, সেদিন মুজাহিদ ভায়ের চোখে অনেক আনন্দ অশ্রু ঝরতে দেখেছি। এই অশ্রু তার একাগ্রতা ও নিষ্ঠার পরিচয় বহন করে।
ফাঁসির মন্চে জীবন দেয়ার পূর্বে তিনি প্রায় সাড়ে ৫ বছর এক নাগাড়ে জেলে ছিলেন। এসময়ে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, গাজীপুর জেলা কারাগার, এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার এবং নারায়নগন্জ জেলা কারাগারে অবস্থান করেন। জেলে থাকা অবস্থায় আমি অনেকবার তার সাথে সাক্ষাত করেছি। সবসময়ই তাকে উজ্জিবীত ও আশাবাদী হিসাবে দেখেছি। তিনি অত্যধিক আশাবাদী ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহর উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। বনী ইসরাইলকে সাথে নিয়ে হযরত মূসা (আ:) এর মিসর ত্যাগের ঘটনা তিনি একদিন আমার কাছে বর্ননা করছিলেন। পিছনে ফেরআউনের বাহিনী, সামনে গভীর সমুদ্র। “আল্লাহ তায়ালা এই অবস্থায় যদি মূসা (আ:) কে সাহায্য করতে পারেন, তবে তিনি আমাদেরকেও সাহায্য করবেন।” কথাগুলো বললেন অত্যন্ত দীপ্ত কন্ঠে। আলী আহসান মুজাহিদের অভাব ইসলামী আন্দোলনে কখন পূরন হবে?
সরকার পক্ষ তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ৭টি অভিযোগ দায়ের করেন। ২৯ জুন ২০১০ সালে গ্রেফতার হলেও সরকার পক্ষ তার বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ দায়ের করে ১৮ মাস পরে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে। গ্রেফতারের ২ বছর পর ট্রাইব্যুনাল ২০১২ সালের জুন মাসে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। নুরেমবার্গ থেকে শুরু করে বসনিয়া, কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন সহ দুনিয়ার যতগুলো ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য ছিল সম্পুর্ন ব্যাতিক্রমধর্মী। সার্বিয়ান নেতা স্লোভাডন মিলসভিচকে যেদিন দা হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গ্রেফতার করে হাজির করা হয়, তার পরের দিনই তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ১৭ই জুলাই ২০১৩ সালে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। ২০১১ সালের অক্টোবর মাস থেকে নিয়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে তার প্রধান কৌশলী হিসাবে মামলা পরিচালনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার মামলা পরিচালনায় আমাদের অত্যন্ত উন্নত মানের পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফলাফল যা হওয়ার তাই হল।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে যাওয়ার ফলে, সুপ্রিমকোর্টে তার আপীল ও রিভিউ পরিচালনা থেকে আমি বন্চিত হয়েছি। ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করার সময় কোন কোন দিন একসাথে গ্রেফতারকৃত সকল নেতৃবৃন্দকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। একদিনের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ অধ্যাপক গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। মুজাহিদ ভাই তার পাশে বসা ছিলেন। তড়িঘড়ি করে আমরা এম্বুলেন্স ডেকে তাকে হাসপাতালে পাঠালাম। মুজাহিদ ভাই আমাকে বললেন, অধ্যাপক সাহেবের কিছু হলে আমাদেরকে প্যারোলে বের করে তার জানাজায় অংশগ্রহনের সুযোগ করে দিতে হবে। ২৩শে অক্টোবর ২০১৪ সালে অধ্যাপক সাহেব ইন্তেকাল করেন। ২৪শে অক্টোবর তার বিশাল জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বাইতুল মোকাররমে। প্যারোলের মাধ্যমে তার জানাজায় অংশগ্রহনের সুযোগ মুজাহিদ ভাই পাননি।
মুজাহিদ ভাই সহ ৫ জন শহীদের আমি সহকর্মী ছিলাম। একসাথে খাওয়া, বৈঠক করা ও সফর করার অনেক স্মৃতিই আজ মনে পড়ছে। মগবাজারের ৫০৫ নম্বর বাড়ীটি সপ্তাহের ৭ দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নেতা, কর্মী, সাংবাদিক এবং সাধারন মানুষের পদচারনায় মুখরিত থাকত। দুই ঈদে বিদেশী কূটনৈতিকরা আসতেন ঝাকে ঝাকে। মাঝে মাঝে বিদেশী সাংবাদিকরাও আসতেন। আসতেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও। কিন্তু আজ সেখানে পশু, পাখি যেতেও ভয় পায়। আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে, অনেক স্মৃতি মনের কোঠায় ভেসে উঠছে। কুশলাদি বিনিময়ের পর অধ্যাপক গোলাম আযমের উক্তি, “কি মনে করে তুমি এসেছো?” নিজামী ভায়ের ভারী কন্ঠস্বর, “জি ব্যারিষ্টার!” মাওলানা একেএম ইউসূফের চিকন গলার আওয়াজ, “ব্যারিষ্টার রাজ্জাক সাহেব নাকি?” মুজাহিদ ভাইয়ের, “জি রাজ্জাক ভাই”, কামারুজ্জামানের, “জি ব্যারিষ্টার সাহেব”, মোল্লা ভায়ের মুচকি হাসি আর মীর কাশেম আলির অট্টহাসি।
সাত সাগর আর তেরনদীর ওপারে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত অতি পরিচিত দ্বীপপুন্জের এই দেশে বসে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় অনেক সময় ভাবি কখন সুযোগ হবে জন্মভূতিতে ফিরে গিয়ে শহীদদের কবরের পাশে দাড়াবার! এই নীরিহ, নিরপরাধ, নিস্পাপ মানুষগুলোকে মিথ্যা মামলায় মানুষের আদালতে ডিফেন্ড করার সৌভাগ্য অর্জন করলাম, আল্লাহ তায়ালার আদালতে তারা কিভাবে সমাদৃত ও সম্মানিত হবেন, তা দেখার সৌভাগ্য কি হবে? রাব্বুল আলামীন ছাড়া এই জ্ঞান আর কার কাছে নেই।
শহীদের মিছিল অনেক অনেক লম্বা। ১৫ই আগষ্ট ১৯৬৯ সালে মালেক ভায়ের শাহাদাতের পর মাওলানা মওদূদী (রহ:) বলেছিলেন, “ আব্দুল মালেকের শাহাদাত প্রথম হতে পারে কিন্তু শেষ নয়”। এই লম্বা মিছিলের কয়জন শহীদকেই বা আমরা ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি? কিন্তু যুগ যুগ ধরে ফাঁসির কাষ্টে যারা শাহাদাত বরন করেছেন, তাদের সংখ্যা সীমিত। মুজাহিদ ভাই স্বরনে যখন লিখছি, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এ দুআই করছি: ফাঁসির কাষ্ঠে জীবন দেয়া কোন সহকর্মীকে নিয়ে আর যেন স্মৃতিচারন করতে না হয়। কিন্তু মহান মাবুদের কি পরিকল্পনা, তা শুধু তিনিই জানেন।
পাঠক মন্তব্য
ধন্যবাদ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাহেবকে শহীদ আলী আহসান মুজাহীদ সাহেবকে নিয়ে স্স্মৃতি চারণমূলক লেখাটি লেখার জন্য। তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যান্ত মধুর ছিল। কোন ধরনের কৃত্রিমতা তাদের ভালবাসায় ছিল না। যারা আদর্শিক কারনে রাজ্জাক সাহেবদের বিরোধীতা করে এটা বিরোধীতাকারীদেরই আদর্শ হতে পারে। রাজ্জাক সাহেবের লেখার শেষের দিকে তাকে সম্ভোধনের ভাষায় প্রমাণ করে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গভীর ছিল।
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন