শারমিন আকতার
প্রস্তাবনাঃ ইংরেজিতে একটি কথা আছে- “Literature is the reflection of human experience.” অর্থাৎ “সাহিত্য হচ্ছে মানুষের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ।” সাধারণ জ্ঞানে আমরা এটুকু জানি যে, কোন ব্যক্তির রুচিবোধ এবং চিন্তা-চেতনা যেমন তার কথাবার্তা এবং কাজকর্মও সাধারণত তেমনই হয়ে থাকে । তেমনি একজন লেখকের মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, দর্শন যেরকম হয়ে থাকে তার সেই ধ্যান-ধারণাও কিন্তু তার সৃষ্ট সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় । যেমন কোন লেখক যদি আস্তিক হয়ে থাকেন তাহলে তার সাহিত্যে কিন্তু স্রষ্টার প্রতি তার আস্থার প্রতিফলন ঘটে । তদ্রূপ কেউ যদি নাস্তিক হয়ে থাকেন তাহলে সেটাও কোন না কোন ভাবে তার সাহিত্যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে । আস্তিক মানুষের সাহিত্যে কখনও নাস্তিকতার ভাব এবং নাস্তিক মানুষের সাহিত্যে কখনও স্রষ্টার গুণ কীর্তন ফুটে উঠে না । আর আস্তিক বা নাস্তিক যেই হউন না কেন তা যদি সুকৌশলে এড়িয়ে যান তা ভিন্ন কথা । তবে দুই এক লেখায় এড়িয়ে গেলেও সারা জীবনের সাহিত্য কর্মের কোথাও তার প্রতিফলন ঘটেনি এমন ঘটনা আছে বলে আমর জানা নেই । বেগম রোকেয়ার সময়ের মুসলিম সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাকে বিপরীত স্রোতে ভাসা মানুষ হিসাবে বিবেচনা করলেও আমাদের এই শিক্ষিত ও অগ্রসরমান সমাজে তাকে নিয়ে বেশ একটা অস্বচ্ছ ধারণার উপস্থিতি খেয়াল করা যায় । যারা ধর্ম মানেন না তারা তাকে তথাকথিত নারী স্বাধীনতা ও প্রগতির অগ্রপথিক হিসাবে শ্রদ্ধা করেন । অন্য দিকে আর এক শ্রেণীর লোক তাকে ধর্মদ্রোহী নারী ভাবেন । অবশ্য এর মাঝামাঝিও কিছু লোক আছে যারা বেগম রোকেয়াকে যৌক্তিক কারণে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন । বেগম রোকেয়া আসলে কেমন ছিলেন? সত্যিকার অর্থে ধর্ম মানতেন না ধর্ম বিরোধী ছিলেন? এ নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় । আসলে কেমন ছিলেন তিনি? এখানে তার সাহিত্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে শুধু বিশ্লেষণ ধর্মী কিছু বক্তব্য রাখা হবে, পাঠক নিজেই বিচার বিশ্লেষণ করে নিবেন তিনি কেমন ছিলেন। পর্দা প্রথার প্রতি দৃঢ় সমর্থনঃ নারীর সম্মান রক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ইসলামের পর্দার বিধানকে তিনি কখনওই খারাপ মনে করতেন না। তিনি নিজে পর্দা করতেন এবং পর্দার সপক্ষে কথা বলেছেন। বেগম রোকেয়া মূলত অতিরঞ্জিত অবরোধ প্রথার বিরোধী ছিলেন, সঠিক পর্দা প্রথার বিরোধী তিনি কখনই ছিলেন না । তার কথায় জানা যায় তিনি নিজেও সম্ভবত পর্দা করতেন বোরকা পরে । এমনকি বোরকা নামে একটি অসাধারণ প্রবন্ধই লিখেছেন । যেখানে তিনি পর্দা প্রথার গুণগান করেছেন সুন্দর যুক্তির মাধ্যমে। তিনি তার বোরকা প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন- “আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে আমাদের “জঘন্য অবরোধ প্রথা” ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায় । উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহরা প্রায়ই আমাকে “বোরকা” ছাড়িতে বলেন । বলি উন্নতি জিনিসটা আসলে কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তাহলে জেলেনী, চামারিনী, ডুমিনী, প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে ।” [বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠাঃ ৫৯, রোকেয়া রচনাবলী)] বোরকা বা পর্দা করাকে অনেকে পশ্চাদপদতা মনে করায় তিনি তারও জবাব দিয়েছেন সুন্দর যুক্তি দিয়ে । তিনি বলেছেন- “পৃথিবীর অসভ্য জাতিরা অর্ধ- উলঙ্গ অবস্থায় থাকে । ইতিহাসে জানা যায়, পূর্বে অসভ্য বৃটেনরা অর্ধনগ্ন থাকিত । ঐ অর্ধনগ্ন অবস্থার পূর্বে গায়ে রঙ মাখিত । ক্রমে সভ্য হইয়া তাহারা পোশাক ব্যবহার করতে শিখিয়াছে ।” [বোরকা, মতিচুর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৫৯)] বোরকাকে অনেকে বিরক্তিকর ভারি পোশাক হিসাবে অভিযোগ উত্থাপনের প্রেক্ষিতেও তিনি সুন্দর যুক্তি দাড় করিয়েছেন । তিনি বলেছেন – “অনেকে বোরকাকে ভারি বলিয়া আপত্তি করেন । কিন্তু তুলনায় দেখা গিয়েছে ইংরাজ মহিলাদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বোরকা অধিক ভারি নহে ।” [বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৫৯)] সত্যিকারের পর্দার মর্মার্থ বুঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন- “পর্দা অর্থে তো আমরা বুঝি গোপন করা বা হওয়া, শরীর ঢাকা ইতযাদি-কেবল অন্তপুরের চারি- প্রাচীরের ভিতর থাকা নহে । এবং ভালমতে শরীর আবৃত না করাকেই ‘বে-পর্দা’ বলি । যাহারা ঘরের ভিতর সম্মুখে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় থাকেন, তাঁহাদের অপেক্ষা যাহারা ভালমতে পোশাক পড়িয়া মাঠে বাজারে বাহির হন, তাঁহাদের পর্দা বেশি রক্ষা পায় ।” ( বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৬০)] “আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ (বোরকা) মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নেই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোনো অসুবিধা হয় না। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস চাই, বিনা অভ্যাসে কোন কাজ হয়? ” (বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৫৯-৬০)] তিনি আরও বলেন- “শাস্ত্রে পর্দা সম্বন্ধে যতটুকু কঠোর ব্যবস্থা আছে, প্রচলিত পর্দা প্রথা তদপেক্ষাও কঠোর। যাহা হউক কেবল শাস্ত্র মানিয়া চলিলে অধিক অসুবিধা ভোগ করিতে হয় না। আমার বিবেচনায় প্রকৃত পর্দা সে-ই রক্ষা করে, যে সমস্ত মানব জাতিকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করে।” [কূপমণ্ডুকের হিমালয় দর্শন, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৩৪১)] সভ্যতার সাথে যে পর্দা প্রথার কোন বিরোধ নেই তাও তিনি বলেছেন তার “বোরকা” প্রবন্ধে । তিনি বলেছেন- “ আজিকালি যে সকল ভগ্নী নগ্নপদে বেড়াইয়া থাকেন, তাঁহাদের আত্বীয়া সুশিক্ষিতা (enlightened) ভগ্নীগণ সভ্যতার পরিচায়ক মোজা জুতার ভিতর পদযুগল আবৃত করেন । ক্রমে হাত ঢাকিবার জন্য দস্তানার সৃষ্টি হইয়াছে । তবেই দেখা যাই সভ্যতার সহিত অবরোধ প্রথার কোন বিরোধ নেই । ” [বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৬১)] আধুনিকতার নামে পর্দা প্রথাকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদেরকে অনেক উন্নত নারী হিসাবে বিবেচনা করার অসারতা তিনি তুলে ধরেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে । তিনি বলেছেন- “বর্তমান যুগে ইউরোপীয় রমণীগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন । তাঁহাদের পর্দা নাই কে বলে? তাঁহাদের শয়ন কক্ষে, এমনকি বসিবার ঘরেও কেহ অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করেন না । এ প্রথা কি দোষণীয় ? অবশ্যই নহে । কিন্তু এদেশের যে ভগ্নীরা বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাঁহাদের না আছে ইউরোপীয়দের মত শয়নকক্ষের স্বাতন্ত্র্য (Bedroom Privacy) না আছে আমাদের মত বোরকা ! ” [ বোরকা, মতিচুর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৬০)] তিনি এ ব্যাপারের আরও বলেছেন- “এখন পার্সী মহিলাদের পর্দামোচন হইয়াছে সত্য, কিন্তু মানসিক দাসত্ব মোচন হইয়াছে কি? অবশ্যই হয় নাই । আর ঐ যে পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহা দ্বারা তাদের স্বকীয় বুদ্ধি বিবেচনার ত কোন পরিচয় পাওয়া যায় না । পার্সী পুরুষগণ কেবল অন্ধভাবে বিলাতী সভ্যতা অনুকরণ করিতে যাইয়া স্ত্রীদিগকে পর্দার বাহিরে আনিয়াছেন । ইহাতে অবলাদের জীবনীশক্তির ত কিছু পরিবর্তন পাওয়া যায় না ।- তাঁহারা যে জড়পদার্থ, সেই জড়পদার্থই আছেন । পুরুষ যখন তাহাদেরকে অন্তঃপুরে রাখিতেন তাঁহারা তখন সেখানেই থাকিতেন। আবার পুরুষ যখন তাঁহাদের “নাকে দড়ি” ধরিয়া টানিয়া তাঁহাদিগকে মাঠে বাহির করিয়াছেন, তখনই তাঁহারা পর্দার বাহিরে হইয়াছে! ইহাতে রমণীকূলের বাহদুরী কি? ঐরূপ পর্দা-বিরোধ কখনও প্রশংসনীয় নহে ।” [অর্ধাঙ্গী, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৪৩)] বোরকা প্রবন্ধের শেষে তিনি এভাবে ইতি টেনে বলেছেন- “যাহা হউক। পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাঁটা হইয়া দাঁড়ায় নাই । এখন আমাদের শিক্ষয়িত্রীর অভাব ।এই অভাবটি পূরণ হইলে এবং স্বতন্ত্র স্কুল কলেজ হইলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করিয়াও উচ্চশিক্ষা লাভ হইতে পারে । প্রয়োজনীয় পর্দা কম করিয়া কোন মুসলমানই বোধ হয় শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হইবেন না । আশা করি, এখন আমাদের উচ্চশিক্ষা-প্রাপ্তা ভগিনীগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে বোরকা মোটের উপর মন্দ নহে ।” [ বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৬৩)] ইসালাম, নারী শিক্ষা এবং নারী অধিকার প্রশ্নে বেগম রোকেয়ার অভিমতঃ নারী শিক্ষা বাস্তবায়নে ইসলামের ভূমিকাঃ ইসালামে নারীশিক্ষার উপর যে তাগিদ রয়েছে তিনি তা তার ইংরেজি, বাংলা নানা প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছনে। “The Mussalman” নামক ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত বেগম রোকেয়ার “GOD GIVES, MAN ROBS” নামক ইংলিশ প্রবন্ধে বলেছেন – “Our great prophet has said ‘ Talibul Ilm farizatu ala kulli Muslimeen-o-Muslimat’,( i.e. It is the bounden duty of all Muslim males and females to acquire knowledge.) But our brother will not give our proper share in education.’” [The Mussalman, Dec-6, 1927 (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৫০১)] এর বাংলা অর্থ হচ্ছে- “আমাদের মহান নবী বলেছেন যে ‘তালাবুল ইলমি ফারিজাতু কুল্লি মুসলিমিন-ওয়া-মুসলিমাত’ ( অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক মুসলিম নর এবং নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক) । কিন্তু আমাদের ভ্রাতাগণ আমাদেরকে শিক্ষায় সেই উপযুক্ত অধিকার দিবে না ।” এই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেছেন- “From experience we find that mothers are generally willing to educate their girls, but they are quite helpless, when their husbands and other male relations will not hear of girls attending school. May we challenge such grandfathers, fathers or uncles to show the authority which they prevent their girl from acquiring knowledge? Can they quote from the Quran or Hadis any injunction prohibiting women from obtaining knowledge?” [The Mussalman, Dec-6, 1927 (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৫০২)] এর বাংলা অর্থ হচ্ছে- “আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি যে মায়েরা তাদের মেয়েদেরকে শিক্ষিত করতে বেশ আগ্রহী ।কিন্তু তারা সম্পূর্ণরূপে অসহায়, যখন তাদের স্বামীরা ও অন্যান্য পরুষ আত্বীয়রা কখনই শুনতে চাইবে না যে তাদের মেয়েরা স্কুলে যাক । আমরা কি এমন দাদা, বাবা এবং চাচাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কিসের ভিত্তিতে তারা এমন কর্তৃত্ব প্রদর্শন করছেন? তারা কি কোরআন অথবা হাদিস থেকে এমন কোন injunction উদ্ধৃত করে দেখাতে পারেন যেখানে নারীদেরকে জ্ঞান অর্জনে বাঁধা দেয়া হয়েছে? । ” বেগম রোকেয়ার যুক্তির বিপক্ষে হয়তো অনেকে এখন অভিমত দিতে পারেন যে ইসলামে যা বলা হয়েছে তা ইসলামী জ্ঞান অর্জনের কথা । কিন্তু আপনরা একটা লিস্ট তৈরি করে দেখুন যে কয়জন আলেমে দ্বীন মহিলা আছেন আমাদের সমাজে তথা সারা বিশ্বে? যারা ইসলামকে “পূর্ণাঙ্গ দ্বীন” হিসাবে জানেন ও মানেন । অথচ হাজার হাজার, লাখ লাখ আলেমে দ্বীন পুরুষ রয়েছেন । আর মেয়েদের পক্ষ থেকে সত্যিকার অর্থে মাত্র একজনই; আর তা হচ্ছেন মহীয়সী রমণী হযরত আয়েশা রাঃ । তার মতো আলেমে দ্বীন ও আধুনিক মহিলা আপনি কোথায় পাবেন? পরিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে একটা ছেলেকে বাবা-মা সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করে । তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন হোক বা হাফেজিয়া মাদ্রাসায় হাফেজে কোরআন করানোই হোক । কতোজন মহিলা হাফেজা আছে? আবার কতোজন সর্বোচ্চ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ে আছে? পরিসংখ্যানের দিক থেকে সমাজে ছেলে মেয়ের সংখ্যা সমান হলেও উপরে বর্ণিত উভয় ধরণের শিক্ষা অর্জনকারী ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা সমান কি? যেখানে রাসুল সাঃ বলেছেন-“ প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ ।” নারীদের জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সমগ্র নিস্তেজ মুসলিম জাতিকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে উন্নত জাতি হিসাবে আবার উঠে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়াছেন বেগম রোকেয়া তার “নূর-ইসলাম” নামক প্রবন্ধে দীপ্ত কণ্ঠে । ভারতবর্ষের নিদ্রাতুর জাতিকে এক্ষেত্রে তিনি হযরত আলী রাঃ এর কথা এবং অতীতের ইসলামের স্বর্ণ যুগের কথা তুলে ধরে বুঝাতে চেয়েছেন এভাবে- “পয়গম্বর সাহেবের নিম্নোক্ত বচন সমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমি ভক্তিপ্রেমে অভিভূত হইয়া পড়ি । তিনি বলিয়াছেন, ‘বিদ্বানের (লিখিবার) মসী শহীদ (ধর্মার্থ সমরশায়ী)- দের রক্তাপেক্ষাও অধিক মূল্যবান।’ ভ্রাতৃগণ! বিদ্যার গৌরব বর্ণনা এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পার? হযরত আলী যিনি পয়গম্বর সাহেবের জামাতা ছিলেন, আর জাহার সম্বন্ধে পয়গম্বর সাহেব বলিয়াছেন যে ‘আলী ইসলামে বিদ্যার জ্ঞানের দ্বার স্বরূপ ।’ …… বিদ্যার প্রশংসা বিষয়ে আলীর রচনাবলী হইতে কয়েকটি আমি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি- “অন্তর আলোকিত করিবার জন্য সুশিক্ষা উজ্জ্বল রত্ন; সত্য তাহার (বিদ্যার) লক্ষ্য ।; ঈশ্বরত্বত্ত তাহার পথ প্রদর্শক; বুদ্ধি(সুবোধ?) তাহাকে গ্রহণ করে; মানবের ভাষায় বিদ্যার যথোচিত প্রশংসা হইতে পারে না ।” ওদিকে মুসলমানেরা দেশ সংক্রান্ত কর্তব্য সাধনে মগ্ন ছিলেন । এদিকে হযরত আলীর শিষ্যবর্গ শিক্ষা বিস্তারে ব্যস্ত ছিলেন । তাঁহারা যেখানেই যাইতেন শিক্ষার মশাল সঙ্গে লইয়া যাইতেন । তাহার ফলে এই হইল যে খৃস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের শিশুদের হস্তেও শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রদীপ দেওয়া হইয়াছিল । যেখানে তাঁহারা দেশ জয় করিতেন সেখানেই পাঠশালা ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন । ইহার প্রমাণ স্বরূপ কাহেরা, বাগদাদ, হিসপানিয়া এবং কর্ডোভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ প্রদর্শন করিতেছি ।* [এখানে তিনি স্টার চিহ্ন দিয়ে পাদটীকা হিসাবে উল্লেখ করেছেন- আমাদের সদাশয় বৃটিশ প্রভুরা দাবি করেন যে তাঁহারা অনুগ্রহ পূর্বক ভারতবর্ষ জয় করিয়াছেন বলিয়াই আমরা (বর্বরেরা) শিক্ষার আলোক প্রাপ্ত হইয়াছি । আর আমরাও নত মস্তকে স্বীকার করিয়া বলি যে- “ইয়ে হয় আহলে মগরেবকে বরকৎ কদমকী” ( ইহা পশ্চিম দেশবাসিদিগের শ্রীচরণের প্রসাদ) কিন্তু মিসেস বেদান্ত ত বলেন শিক্ষা বিস্তার বিষয়ে মুসলমানরাই ইউরোপের গুরু ।] ইংল্যান্ডের লোকদিগকে মুসলমানরাই তাঁহাদের বিস্মৃত বিদ্যার বর্ণমালার পুস্তকাবলী অধ্যায়ন করাইয়াছিল। তাঁহারা জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যায়ন করিয়াছেন, ভারতবর্ষের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক পুস্তকের অনুবাদ করাইয়াছেন; রসায়ন এবং অঙ্ক শাস্ত্রের পুস্তকাবলী রচনা করিয়াছেন । জনৈক পোপ (দ্বিতীয় মিসলউটিয়র) যিনি খৃীস্টীয় ধর্মের অতি উৎকৃষ্ট পণ্ডিত ও গুরু ছিলেন, তিনি মুসলমানদেরই কর্ডাভা মাদ্রাসায় অঙ্ক শাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলেন । এই কারণে লোকে তাকে বিধর্মী বলিয়া জনসমাজে অপদস্ত করিয়াছিল এবং তাহাকে ‘শয়তানের বাচ্চা’ বলিয়াছিল । ইহাতে স্পষ্ট জানা যায় সে সময় ইউরোপের খৃীস্টীয় বিভাগ কেমন ঘোর মূর্খতায় তমাসাচ্ছন্ন ছিল, আর কেবল ইসলামের অনুবর্তীগনই তাহাদিগকে (ইউরপিয়দিগকে) জ্ঞানের আলোকরশ্মি দেখাইতেছিলেন ।” [নূর- ইসলাম, মতিচূর, দ্বিতীয় খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৯৪-৯৫)] সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আদায়ে ইসলামের অবদানঃ বেগম রোকেয়া দৃপ্ত কণ্ঠে বারবার বিভিন্ন জায়গায় উচ্চারণ করেছেন সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রদান করেছে ইসলাম । কিন্তু সমাজের লোভী, গোঁড়া এবং অজ্ঞ মানুষগুলোর কারণে নারীরা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন । তিনি বলেছেন – “‘মহাম্মদীয় আইন’ অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই- ‘আমাদের বাড়িও’ হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়,- বাড়ীর প্রকৃত কর্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর হ’ন । তাঁহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি মালিক! ………তাই বলি, গৃহ বলতে আমাদেরই একটা পর্ণকুটির নাই। প্রাণী জগতে কোন জন্তুই আমাদের মতো নিরাশ্রয়া নহে । সকলেরই গৃহ আছে- কেবল নাই আমাদের* ।” [গৃহ, মতিচুর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৬৮ ও ৭২)] (* “গৃহ” প্রবন্ধের শেষের লাইনে স্টার চিহ্ন দিয়ে এর জন্য তিনি পাদটীকা হিসাবে উল্লেখ করেন- “আমাদের যেসব ভগ্নী গৃহসুখভোগ করেন এই সন্দর্ভটি তাঁহাদের জন্য লিখা হয় নাই- ইহা গৃহহীনাদের জন্য ।”) বেগম রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে নারীদেরকে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করায় মুসলিম সমাজের পুরুষদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়েন- “যদি ধর্মগুরু মুহাম্মদ (দঃ) আপনাদের হিসাব নিকাশ লয়েন যে ‘তোমরা কন্যার প্রতি কি রূপ ন্যায় ব্যবহার করিয়াছ ? তবে আপনারা কি বলিবেন’।” [অর্ধাঙ্গী, মতিচুর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৪৮)] মুসলিম নারীদের ইসলাম যে শুধু অনেক অধিকার দিয়েছে তা বলেই তিনি ক্ষান্ত থাকেন নি বরং বারবার নারীদের অধিকার আদায়ে ইসলাম ধর্মের আইন কানুনের বাস্তব প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি কাকুতির সাথে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন জায়গায় । যেমন- “হায় পিতা মোহাম্মদ (দঃ) ! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্তে পিতৃসম্পত্তিতে অধিকারী করিয়াছ, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্বনাশ করিতেছে!! আহা! “মহম্মদীয় আইন” পুস্তকের মসি- রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে । টাকা যার, ক্ষমতা যার আইন তাহারই । আইন আমাদের ন্যায় নিরক্ষর অবলাদের জন্য নহে !” [গৃহ, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৭০)] তিনি আরও বলেন- “মুহাম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে। … তবে দেখিবেন কার্যতঃ কন্যার ভাগ্যে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।” [অর্ধাঙ্গী, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৪৭)] বেগম রোকেয়া মুসলিম সমাজের অধিকার বঞ্চিতা নারীদেরকে সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন- “পয়গম্বরের ইতিহাসে শুনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশি অত্যাচার অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করিয়াছেন । আরবে স্ত্রী জাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যা হত্যা করিতেছিল। তখন হযরত মুহাম্মদ কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন । তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন । তাহার জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন- কন্যা কিরূপ আদরণীয়া । সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল । আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা । ” [ অর্ধাঙ্গী, মতিচুর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৪৮)] সৃষ্টিকর্তা ও তার বিধানের প্রশংসাঃ “প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণ সমূহের মধ্যে প্রধান …। নূর ইসলাম, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ- নিবন্ধ ( রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৮০) স্রষ্টার গুণকীর্তনে তার মনের ব্যাকুলতা এবং গুণকীর্তন না করা যে এক ধরণের অন্যায় তা তিনি তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে । যেমন- “আমাদের বাসা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে বড় একটা ঝরনা বহিতেছে, এখান হইতে দগ্ধফেননিভ জলের স্রোত দেখা যায় । দিবানিশি তাহার কল্লোল গীতি শুনিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ বেগে প্রবাহিত হয় । বলি প্রাণটাও কেন ঐ নির্ঝরের ন্যায় বহিয়া গিয়া পরমেশ্বরের চরণ প্রান্তে লুটিয়া পড়ে না? ” [কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৩৩৯)] বেগম রোকেয়া তার ইংরেজি প্রবন্ধ “GOD GIVES MAN ROBS” There is a saying, “Man proposes, God disposes,” but my bitter experience shows that God gives Man robs. The Mussalman পত্রিকায় প্রকাশিত (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৫০১) এর বাংলা অর্থ হচ্ছে- “একটি কথা প্রচলিত আছে যে “ মানুষ প্রস্তাব দেয়, আর স্রষ্টা কেড়ে নেয় । কিন্তু আমি আমার কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে ঈশ্বর প্রদান করেন আর মানুষ হরণ করে ।” “আমাদের এমন সুন্দর চক্ষু, কর্ণ, মন লইয়া যদি স্রষ্টার গুণকীর্তন না করি, তবে কৃতঘ্নতা হয় না? মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সব লইয়া উপাসনা করিলে তবে তৃপ্তি হয় । কেবল টিয়া পাখির মত কণ্ঠস্থ কতকগুলি শব্দ উচ্চারণ করিলে ( অন্তঃত আমার মতে) উপাসনা হয় না । তদ্রূপ উপাসনায় প্রাণের আবেগ কই? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন কালে মন প্রাণ স্বতঃই সমস্বরে বলিয়া উঠে, ‘ঈশ্বরই প্রশংসার যোগ্য । তিনিই ধন্য’।” [কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৩৪২)] ইসলাম, ইসলামী বিধান ও রাসুলের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের বিপক্ষে বেগম রোকেয়া কর্তৃক সমুচিত জবাব প্রদানঃ বেগম রোকেয়া ইসলামী বিধান সারা জীবনে তার সাধ্যানুযায়ী শুধু মান্য করেছেন এবং তার প্রশংসাই করে গেছেন তা নয়, এর পাশাপাশি তিনি তথাকথিত প্রগতিশীল ধর্মহীন মানুষ এবং বিধর্মীদের ইসলাম ও রাসুল সাঃ এর বিরুদ্ধে আনিত মিথ্যে অভিযোগের সমুচিত জবাবও দিয়েছেন অসাধারণ নৈপুণ্য ও পাণ্ডিত্যের সাথে। তিনি বলেছেন- “ভদ্র মহোদয়গণ! এখন আপনাদিগকে আরবীয় পয়গম্বরের প্রতি যে সব অন্যায় দোষারোপ করা হয়, তাহার বিষয় বলিতেছি । অনভিজ্ঞতা ও ন্যায়ান্যায় জ্ঞানাভাবে, অথবা শুধু কুসংস্কারবশতঃ রাসুলের প্রতি ঐসব দোষারোপ করা হইয়া থাকে । তাহার একতম দোষ এই বলা হয় যে, তিনি জীবনের শেষভাগে সর্বশুদ্ধ ৯ জন মহিলার পাণিগ্রহণ করেন । তিনি বিবাহ করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আপনারা কি আমাকে বুঝিয়া দিতে পারেন যে সেই ব্যক্তি যিনি ২৪ বৎসর বয়ঃক্রম পর্যন্ত কোন প্রকার ‘মকারাদি’ কু অবগত ছিলেন না, পরে নিজের অপেক্ষা অধিক বয়স্কা একটি বিধবার পাণিগ্রহণ করিয়া তাহারই সহিত অতি সুখে ২৬টি বৎসর যাপন করিলেন; তিনি শেষ বয়সে, যখন মানুষের জীবনীশক্তি নির্বাপিত হয়, শুধু আত্মসুখের জন্য যে কতকগুলি বিবাহ করিবেন, তাহা কি সম্ভব? যদি ন্যায় বিচারের সহিত বিবেচনা করেন, তবে আপানরা বেশ জানিতে পারিবেন- সে বিবাহের উদ্দেশ্য কি ছিল । প্রথমে দেখিতে হইবে, তাঁহারা (হজরতের পত্নিগণ) কোন শ্রেণীর কুলবালা ছিলেন, আর কেনই বা তাহদের রাসুলের প্রয়োজন ছিল ।-কতিপয় নারী এরূপ ছিলেন যে তাঁহাদের বিবাহের ফলে রাসুলের পক্ষে ‘নূর-ইসলাম’ প্রচারের সুবিধা হইল । আর কয়েক জন এরূপ ছিলেন যে, বিবাহ ব্যতীত তাঁহাদের ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অন্য কোন উপায় ছিল না ।” [নূর-ইসলাম, মতিচূর, দ্বিতীয় খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৯২)] তিনি আরও বলেছেন- “প্রত্যেক ধর্মে কিছু না কিছু দোষ জন্মিয়াই থাকে; সমস্ত সাধু প্রকৃতির লোকের কার্য্যকলাপে কোন না কোন দোষ থাকেই, বিধর্মী এবং মূর্খ শিষ্য একে আর বুঝিয়া থাকে । কোন ধর্ম দেখিতে হইলে সেই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং নিষ্ঠাবান মানুষকে দেখা উচিৎ; তাহা না করিয়া কোন নরাধমকে দেখিয়াই তাহাকেই দৃষ্টান্ত বলিয়া ধারণা করা অন্যায় । তবেই আমরা একে অপরের ভ্রাতার ন্যায় ভালবাসিতে শিখিব এবং বন্য অসভ্যদের মত একে অপরকে ঘৃণার চক্ষে দেখিব না …… প্রত্যেক ধর্মেই বাহ্যিক অবস্থার পরে দর্শন থাকে । যদি এ সময় ইসলামের বর্তমান অবস্থায় আমরা তাহার স্বল্পতা দেখিতেছি, (তাহাতে বিশেষ ক্ষতি নাই) কারণ, আমরা যখন সেই সময়ে- যখন ইসলামের জ্যোতি আরম্ভ হইয়াছিল, দৃষ্টিপাত করি তাহার গুণ ব্যাখ্যার উপযুক্ত ভাষা ও শব্দ পাই না ।” [নূর-ইসলাম, মতিচূর, দ্বিতীয় খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৯৩-৯৪)] সাধারণ মুসলমানদের রোজার উপকারিতার বিপক্ষে কিছু পাদ্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন- “পাদ্রীগণ বলিয়া থাকেন যে, মুসলমানদের রোজায় স্বাস্থ্য ভঙ্গ ব্যতীত কোন ফল লাভ হয় না, এ কথা যুক্তিহীন ।… তবে মুসলমান নামধেয় জীবগণ যদি রোজার সব নিয়মগুলি যথাবিধি পালন না করে, সে দোষ তাদের,- রোজার নহে ।” [ রসনা পূজা, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ (রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৩৪৬)] নারী মুক্তি ও স্বাধীনতায় তার অবদানঃ তার “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধে তিনি নারীদের অবনতির কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । নিদ্রাতুর নারী জাতিকে কিছুটা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বিভিন্নভাবে । শুরুতেই তিনি নারীদের আহবান করে বলেছেন- “পাঠিকাগণ! আপনারা কি কোন দিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি?” [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ২৯)] “আমাদের শয়ন কক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, তদ্রপ মনকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না । যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল এক প্রকারে নাই । পুরুষ যতো ইচ্ছা অধ্যায়ন করিতে পারেন-কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞান রূপ সুধা ভাণ্ডারের দ্বার কখনও সম্পূর্ণ রূপে উন্মুক্ত হবে কি? যদি কোন উদারচেতা মহাত্মা দয়া করিয়া আমাদের হাত ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হন, তাহা হইলে সমস্ত জনে বাঁধা বিঘ্ন উপস্থিত করেন ।” [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৩৫)] অকর্মণ্য ও জ্ঞান অর্জনে বিমুখ নারীদেরকে তিনি প্রশ্ন করে বলেছেন- “যদি ঈশ্বর হিসাব নিকাশ লয়েন যে, ‘তোমরা মন, মস্তিষ্ক, চক্ষু প্রভৃতির কি সদ্ব্যবহার করিয়াছ?’ তাহার উত্তরে বেগম কি বলিবেন? ” [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৩৫)] তিনি এ প্রবন্ধে আরও বলেছেন- “নারী হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির, মস্তস্ক, হৃদয় সবই ‘দাসী’ হইয়া পড়িয়াছে । এখন আর আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতা, ওজস্বিতা বলিয়া কোন বস্তু নাই-এবং ইহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয় না ! তাই বলিতে চাই- ‘অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!’ প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমানগণ আমাদের ‘কৎল’ এর (অর্থাৎ প্রাণদণ্ড) বিধান দিবেন । হিন্দু তুষানল বা চিতানলের ব্যবস্থা দিবেন জানি! ( এবং ভগিনীদেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি) কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতেই হইবে । কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে (“But Nevertheless it (Earth) does move”)!!” [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৩৭)] তিনি এই প্রবন্ধের শেষের দিকে বলেছেন- “আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ । আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাধিয়া রাখিলে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া সে কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই । তাহদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই । শিশুর জন্য পিতামাতা- উভয়েরই সমান দরকার । কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের পথে- সর্বত্র আমরা যাহাতে তাঁহাদের পাশাপাশি চলতে পারি, আমাদের এরূপ গুণ থাকা আবশ্যক । ” [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৩৯)] এই বক্তব্যের একটু আগেই তিনি নারী স্বাধীনতার মর্মার্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন- “স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে । এখন প্রশ্ন হইতে পারে কি করলে লুপ্ত রত্ন উদ্ধার হইবে? কি করিলে আমাদের দেশের উপযুক্ত কন্যা হইব? প্রথমতঃ সাংসারিক জীবনে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা বা দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক । এবং আমরা গোলাম জাতি নই এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। পুরুষের সমকক্ষতা* বলতে আমাদের যা করিতে হয়, আমরা তাহাই করিব । যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব । আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীম্যাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিস্টার, লেডীজজ- সবই হইব ! পঞ্চাশ বছর পরে লেডী হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে ‘রাণী’ করিয়া ফেলিব !! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম দ্বারা আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীনভাবে ব্যবসা করিতে পারিব না ?” [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৩৮)] (এক্ষেত্রে যাতে পাঠক তার বক্তব্যের ভুল আর্থ না বুঝেন সে জন্য তিনি পুরুষের সমকক্ষতা বুঝাতে পাদটীকা উল্লেখ করে বলেন- *আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বুঝিয়েছি । নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষদের অবস্থায় আমাদের উন্নতির আদর্শ । একটা পরিবারের পুত্র ও কন্যায় যে রকম সমকক্ষতা থাকা উচিত, আমরা তাহাই চাই । যেহেতু পুরুষ সমাজের পুত্র আমরা সমাজের কন্যা! আমরা ইহা বলি না যে ‘কুমারের মাথায় যেরকম উষ্ণীষ দিয়েছেন সেরকম আমাদের মাথায়ও তাহাই দিবেন! বরং এই বলি কুমারের মস্তক শিরস্ত্রাণে সাজাইতে যতখানি যত্ন এবং ব্যয় করা হয়, কুমারীর মাথা ঢাকিবার ওড়নাখানা প্রস্তুতের নিমিত্তেও ততখানি যত্ন ব্যয় করা হউক ।) [স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলী,পৃষ্ঠাঃ ৩৮)] “রোকেয়া রচনাবলী” পড়লে দেখা যাবে যে অধিকাংশ জায়গাতেই তিনি তার ইসলাম ধর্মের এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রশংসা করেছেন দীপ্ত ভঙ্গিতে । শুধু সত্যিকারের ধর্মের সাথে সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থা তুলনা করে পুরুষ জাতিকে বুঝাবার চেষ্টা করেছেন বারংবার যে নারীদের যা অধিকার দিয়েছে ইসলাম ধর্ম তা লঙ্ঘিত হচ্ছে । নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের স্বার্থপরতা এবং নারীদের অজ্ঞতার কারণে । সমাজে ধর্মের নামে প্রচলিত যেসব ভ্রান্তি এবং বেদয়াত রয়েছে সেগুলোর অসারতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন তিনি অনেক বার। “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধের কারণেই মূলত অনেকে তাকে তথাকথিত প্রগতিশীল এবং নারীবাদী হিসাবে ধারণা করে থাকেন । তার সমগ্র সাহিত্য কর্মের প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার অধিক অংশের মধ্যে এই প্রবন্ধটি মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার । এখানে তিনি নারীদের জ্ঞান চর্চা, সমাজসেবা, পরিবারের বিপদে স্বাবলম্বী হয়ে পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় সাজগোজের দিকে মনোনিবেশ করার কুফলও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সুনিপূনভাবে। নারীদের মানসিক দাসত্ব ঘোচানোর আহবান করেছেন । প্রথমে ইহা গ্রন্থিত হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিভিন্ন নামে । “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে গিরিশ চন্দ্র ( কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক হিসাবে যার নামের সাথে আমরা পরিচিত) সম্পাদিত মাসিক মহিলা পত্রিকায় পরপর তিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে । তখন এর শিরোনাম ছিল “অলঙ্কার না Badge of Slavery?” পরে “আমাদের অবনতি” নামে সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকায় এটি পুনরায় মুদ্রিত হয় । উভয় ক্ষেত্রে প্রবন্ধে ব্যক্ত রোকেয়ার ধর্ম সম্পর্কিত কিছু মন্তব্য বা অভিমত একশ্রেণীর পাঠকের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে । যেমন রোকেয়া তার প্রবন্ধে বলেছিলেন- “আমাদিগকে প্রতারণা করিবার নিমিত্তে পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ‘ঈশ্বরের আদেশপত্র’ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন …। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে- কথা শুনিতে পাও, কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে । ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে …।” পরবর্তীতে বিতর্কিত এই বক্তব্যটি তিনি উইথ ড্র করে নেন । তার প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ মতিচূর, প্রথম খণ্ডে “স্ত্রী জাতির অবনতি” নামে অন্তর্ভুক্তির সময় এই অংশটি তিনি বাদ দিয়ে দিয়েছেন । যিনি তার সমগ্র সাহিত্য কর্মে স্রষ্টার মাহাত্ম্য, তার বিধিবিধানের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে গেছেন সব সময়; স্রষ্টার সৃষ্টির গুনকীর্তন, মানব জাতির জন্য তার বিধিবদ্ধ বিধানের প্রশংসা করে গেছেন বারবার; তিনি কিভাবে সেই স্রস্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেত পারেন? সেই সময় মুসলিম নারীদেরকে তাদের নিজস্ব ধর্ম প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সুবিধা ও অজ্ঞতার কারণে ধর্মের নামে যেসব বেদয়াত,বাড়াবাড়ি ছিল শুধুমাত্র সেইসব ধর্মীয় তথা অধর্মীয় অনুশাসনের মুণ্ডুচ্ছেদ করার জন্যই তিনি তা বলেছিলেন কি না তা সৃষ্টিকর্তায় ভালো জানেন । ঐ অংশ বাদ দেয়ার পরও এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর পাঠক সমাজে এর ব্যাপারে আলোচনা, সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে । অনেকেই এই প্রবন্ধের জন্যই তাকে পর্দা প্রথার বিরোধী ভাবা শুরু করতে লাগলেন । অথচ “বোরকা” নামে একটি প্রবন্ধে বারংবার তনই পর্দার গুণগান এবং প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে গেছেন । “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে সমাজে যে সমালোচনার ঝড় বইতেছিল তার প্রেক্ষিতে তিনি তার “অর্ধাঙ্গী” প্রবন্ধে জবাব দিয়েছেন এইভাবে- “আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার “স্ত্রী জাতির অবনতি” প্রবন্ধে পর্দা বিদ্বেষ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই। সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারী জাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের) আলোচনা করিয়াছি। ” [অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৪৩)] নারীদের স্বাধীন হওয়ার আহবান দিয়েছেন বলে তিনি কিন্তু ধর্মীয় বন্ধন ছিন্ন করতে বলেন নি । ধর্মীয় বিধানের সীমা সঠিকভাবে জেনে এবং ধর্মীয় বন্ধন রক্ষা করেই মানসিক উন্নতি সাধনের কথা বলেছেন । মেয়েদের দাস মনোবৃত্তি ছেড়ে মুক্ত চিন্তার সুবিবেচক মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন- “আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না । মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রীষ্টানকে খ্রীষ্টানী ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই । আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেয়া যায় । আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই । ” [অর্ধাঙ্গী, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৪৯)] তিনি আরও বলেছেন- “সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ সংকীর্ণমনা ও ভীরু হয়ে পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই-শিক্ষার অভাবে হইয়াছে । সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে ।” [বোরকা, মতিচুর, প্রথম খণ্ড (রোকেয়া রচনাবলী,পৃষ্ঠাঃ ৬২)] বেগম রোকেয়ার সময়ে যেমন সমাজের মানুষদের কাছে নারীদের জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতো না,সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আজকে এই আধুনিক যুগেও কিন্তু আমরা সেভাবে নারী শিক্ষায় খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারিনি । আজও আমাদের সমাজে দেখা যায় ছেলেদের শিক্ষা অর্জনে বাবারা হজার হাজার টাকা ব্যয়ে প্রস্তুত থাকে । কিন্তু একটা মেয়ের পিছনে শত টাকা খরচ করতেও কুণ্ঠা করে । ভাবে – “মাইয়া মানুষের অতো পইড়া কি লাভ? কয়দিন পরে বিয়া হইয়া স্বামীর বাড়ি চইলা যাইব । সব বৃথা ।” কিন্তু সত্যিকার অর্থে বৃথা যায় কি? আজ কেউ কেউ সেটা বুঝতে শিখেছেন, তাও অনেক পরে । স্বাবলম্বী একটা ছেলের চেয়ে স্বাবলম্বী একটা মেয়ে বাবা-মাকে আর্থিক ও মানসিক দিক থেকে বেশি সাহায্য করে না কি? বেগম রোকেয়া তার “সুবহে সাদেক” প্রবন্ধে ঘুমন্ত ও নির্যাতিত নারী জাতিকে যে বাণীতে জেগে উঠে অগ্রসর হওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন- “ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী আমরা আসবাব নই; বল কন্যে! আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ । আর কার্যত্যঃ দেখাও যে আমরা সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ অংশের অর্ধেক । বাস্তবিক পক্ষে আমরাই সৃষ্টি জগতের মাতা ।” [সুবহে সাদেক, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ, (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৪০০)] এই আহবানের আগে তিনি আরও একবার আহবান দিয়েছেন “সুবহে সাদেক” প্রবন্ধে এই ভাষায়- “জাগো মাতা, ভগিনী, কন্যা- উঠ, শয্যা ত্যাগ করিয়া আইস; অগ্রসর হওঁ। ঐ শুন “মোয়াজ্জিন” আজান দিতেছেন । তোমরা কি ঐ আজান ধ্বনি, আল্লাহর ধ্বনি শুনিতে পাও না? আর ঘুমাইও না; উঠ, এখন আর রাত্রি নাই, এখন সুবহে সাদেক- মোয়াজ্জিন আজান দিতেছেন । যৎকালে সমগ্র জগতের নারীজাতি জাগিয়া উঠিয়াছে, তাঁহারা নানাবিধ সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে-তাহারা শিক্ষা মন্ত্রী হইয়াছে, তাঁহারা ডাক্তার, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, যুদ্ধমন্ত্রী, প্রধান সেনাধ্যক্ষা, লেখিকা, কবি ইত্যাদি ইত্যাদি হিতেছে-আমরা বঙ্গনারী গৃহ-কারাগারে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছি । আর যক্ষ্মা রোগে ভুগিয়া হাজারে হাজারে মরিতেছি ।” [সুবহে সাদেক, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ, (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠাঃ ৩৯৯)] নারীদের জাগরণী বার্তা প্রেরনের পাশাপাশি তিনি সব সময় মুসলিম জাতিকেও সঠিক ভাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করে উন্নয়নের জন্য বারবার জাগার আহাবন দিয়েছেন । “আমাদিগকে মুসলমান বললেও ‘মুসলমান’ শব্দটির অপমান করা হয়। সুতরাং আমাদের ভণ্ড রোজার সম্বন্ধে যে পাদ্রীগণ বলেন ‘Whatever is gained by fasting, is lost by feasting’ (অর্থাৎ দিনে রোজার দ্বারা যে পুণ্য হয়, তাহা রাত্রির অতি ভোজনে নষ্ট হয় ) তাহা ঠিক। আমাদের রোজার উদ্দেশ্য কেবল রস্না-পুজা ! কবে মুসলমান, ‘মানুষ হইবে’ রসনা -পূজা ছাড়িয়া ঈশ্বর পূজা করিতে শিখিবে? জগতের অনেক জাতি জাগিয়া উঠিয়াছে, ভাল-মন্দ বুঝিয়াছে ; কেবল ইহাদের মোহনিদ্রা ভাঙ্গ হয় নাই । এখন তো আমাদের সেই ‘জরির মসনদ’ তাকিয়া বা দুগ্ধফেননিভ শুভ্র কুসুম-কোমল ‘শাহানা বিছানা’ নাই, তবে নিদ্রা যাইতেছি কোন সুখে? আমাদের অবস্থা এই প্রকার- ‘ঝোপড়ী মেঁ রহনা ও মহলকা খাব দেখনা’ অর্থাৎ বর্তমানে কুড়ে ঘরে থাকি এবং অতীতের অট্রালিকার স্বপ্ন দেখি !! একজন কবি বলিয়াছেনঃ I slept and dreamt life was beauty, I woke and found that life is duty.” [রসনা পূজা, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ( রোকেয়া রচনাবলি, পৃষ্ঠাঃ ৩৪৭)] শেষ কথাঃ বেগম রোকেয়ার সময়ে নারীরা জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে অলঙ্কার, গহনা পরার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন । নিজেদের আত্মবিশ্বাস এবং আস্থা না থাকার কারণে নত, অনুন্নত হয়ে ছিলেন । অবশ্য আজকের দিনে বেশি অলঙ্কার পরাটা আধুনিকতার সাথে ততোটা মানাসই মনে করা হয় না। কিন্তু তাই বলে আজকের নারীরা কি অলঙ্কার পরা বাদ দিয়ে জ্ঞান অর্জন এবং নিজেদের উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে? আজকের যুগের আমরা নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট বিরাট ডিগ্রী নিয়ে পুরুষদের মতো বেশ সচেতন হয়ে পারিপার্শ্বিক জ্ঞান অর্জনে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠে নিজেদের অবস্থানের অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছে? আমরা কি জানার চেষ্টা করছি পৃথিবী কিভাবে তার কক্ষ পথে বিচরণ করছে? প্রযুক্তির মাধ্যমে কিভাবে সারা বিশ্বকে জানার পথ খুঁজে পাওয়া যায়? কিভাবে ভিন্নধর্মী দুটি মৌল মিলে একটি অসাধারণ কার্যকর যৌগিক পদার্থ গঠিত হয়? কিভাবে সূর্যের আলো শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে? আমাদের নিজস্ব ধর্ম নারী হিসাবে আমাদেরকে কি কি অধিকার দিয়েছে? সন্তান সঠিক নিয়মে কিভাবে লালন পালন করতে হবে? স্বামী-সন্তান, বাবা-মা, পাড়া- প্রতিবেশীর সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে? পরিবার, সমাজ এবং দেশের প্রতি আমাদের কি ধরণের দায়িত্ব রয়েছে? আজ আমরা নারী জাতির মধ্য থেকে অধিকাংশই নিজেদেরকে তথাকথিত আধুনিক ভাবলেও প্রায় ১০০ বছর পরেও নিজেদের অবস্থানের খুব একটা পরিবর্তন আনতে পেরেছি বলে মনে হয় না । সত্যিকারের উন্নতি ও আভিজাত্যের ভিত্তিতে বিচার করলে দেখা যাবে আমরা আগের মতো সেই একই অবস্থানে রয়ে গেছি । বরং নৈতিক পরিশুদ্ধি এবং আত্মোন্নয়নের ভিত্তিতে বিচার করলে ১০০ বছর পরে আরও বেশি অবনতি ঘটেছে আমাদের । হয়তো আমাদের সমাজে নারী উন্নতি এবং স্বাধীনতার সংজ্ঞাটা শুধু বদলে গেছে । বর্তমানে কতিপয় নারী উন্নয়নের পথে অগ্রগামী হলেও অধিকাংশ নারী জ্ঞান অর্জনের চেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিজেদের অঙ্গসজ্জা, পরচর্চা ও পরনিন্দার প্রতি । কোন পার্লারে সবচেয়ে ভালো ফেসিয়াল করানো হয়? কোন কোম্পানির লিপিস্টক দিলে ঠোটকে বেশি সুন্দর লাগে? কার স্বামীর বেতন কতো? কার স্বামী কাকে কতো হাজার টাকার শাড়ি কিনে দিল? কার ছেলে পরীক্ষায় পাস করতে পারল না? কার অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে ভাল বা খারাপ? আমাদের অধিকাংশ নারীর জ্ঞান অর্জন ও কৌতূহলের সীমা এই পর্যন্তই! বেগম রোকেয়া নারী স্বাধীনতা বলতে মূলত বুঝিয়েছেন নারীর দাসবৃত্তি মনোভাব ত্যাগ করে সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাধীন মানুষ হিসাবে নিজের অধিকার উপভোগ করার পাশাপাশি অজ্ঞতা এবং অকর্মণ্যতা ত্যাগ করে পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য সম্পদ হয়ে উঠা । বেগম রোকেয়া বাস্তবসম্মত নারীবাদীতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মের নামে বাড়াবাড়িকে যেমন অধর্ম বলেছন, সেরকম ধর্মহীনতাকেও মূর্খতার পরিচয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। সত্য কথা বলতে কি তাকে বুঝতে হলে তার কার্যক্রম এবং সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করে তার সঠিক মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করা সকলের উচিৎ । তখন পাঠক নিজেই বুঝতে পারবেন তিনি ধর্মহীনা না ধর্মমনা ছিলেন? কাজী আব্দুল ওদুদ তার মৃত্যুর পর রোকেয়া তার উদ্দেশ্যে বলেন- “মিসেস আর এস হোসেনের প্রতিভা একালের ভগ্ন হৃদয় মুসলমানের জন্য এক দৈব আশ্বাস । নিবাত নিষ্কম্প মুসলমান অন্তঃপুরে যদি এ হেন বুদ্ধির দীপ্তি, মার্জিত রুচি, আত্ননির্ভরতা ও লিপিকুশলতার জন্ম হয় তবে আজো ভয় কেন বাঙলার মুসলমানের ঘোচে না ! তবে আজো কেন নিজেকে পরিবেষ্টনের সন্তান ও জগতের অধিবাসী বলে পরিচয় করিবার সাহস তার হয় না !” বেগম রোকেয়া নিজে তার “নূর-ইসলাম” প্রবন্ধে বলেছেন- “হে ভ্রাতৃগণ! কোন ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা জানিতে হইলে তাহাঁকে ঠিক সেইভাবে দেখুন যে অবস্থায় তিনি বাস্তবিক থাকেন, কুসংস্কারের চশমা পরিয়া দেখিবেন না ।” [নূর-ইসলাম, মতিচূর, দ্বিতীয় খণ্ড, (রোকেয়া রচনাবলি,পৃষ্ঠা ৯৩)] তথ্যসূত্রঃ ১) রোকেয়া রচনাবলি, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত ২) রোকেয়া ও তার জাগৃতি-সাধনা, মোরশেদ শফিউল হাসান (রোকেয়া গবেষক) ৩) http://bn.wikipedia.org/wiki/ ৪) http://www.en.wikipedia.org/wiki/Roquia_Sakhawat_
Hussain লেখকঃ সম্পাদক ও প্রকাশক, মহীয়সী ডটকম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন