ওসমানী সাম্রাজ্যে অমুসলিমদের অধিকার
ইসলামের হারানো ইতিহাস পূর্ববর্তী মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর মতোই ওসমানী সাম্রাজ্যও অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোর প্রতি গভীর সহিষ্ণুতা এবং উদারতা প্রদর্শন করেছে। অমুসলিমদের মর্যাদার ব্যাপারে মুসলিম আইনে যে বিধান রয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই তা করা হয়েছে। শরীয়াহ্ আইন অনুযায়ী, অমুসলিমদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে হবে, ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে হবে এবং তাদের উপর কোন ধরনের জুলুম করা যাবেনা। ইসলামের ইতিহাসের এমন নজিরগুলোর মধ্যে প্রথম একটি নজির ছিল উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) এর চুক্তি, যেখানে তিনি জেরুজালেমের খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।
মিল্লাত পদ্ধতি
১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ (ফাতিহ্ সুলতান মুহাম্মাদ) এর কন্সট্যান্টিনোপোল বিজয়ের পর প্রথমবারের মতো বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান অধিবাসী ওসমানীদের কর্তৃত্বাধীন হয়। ঐতিহাসিকভাবে কনস্ট্যান্টিনোপোল ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের প্রাণকেন্দ্র, তাই সেখানে বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান অধিবাসী রয়ে যায়। ওসমানী সাম্রাজ্য ইউরোপে বিস্তার লাভ করার পর আরো বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান জনসাধারণ ওসমানীদের অধীনে আসতে শুরু করলো। উদাহরণস্বরূপ, ১৫৩০-এর দশকে ওসমানী সাম্রাজ্যের জনসংখ্যার ৮০% এরও বেশী ছিল অমুসলিম। সাম্রাজ্যের এই নতুন নাগরিকদের কথা চিন্তা করে সুলতান মুহাম্মাদ এক নতুন সিস্টেম চালু করেন যা পরবর্তীতে “মিল্লাত পদ্ধতি” নামে পরিচিত লাভ করে।
Sultan Mehmed II with Gennadius Scholarius
ছবিতে কন্সট্যান্টিনোপোল (বর্তমান ইস্তানবুল) বিজয়ী ফাতিহ্ সুলতান মুহাম্মাদকে “ইয়েন্নাদিউস স্কলারিউস” এর সাথে দেখা যাচ্ছে, যিনি ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ওসমানীদের কন্সট্যান্টিনোপোল বিজয়ের পর প্রথম অর্থোডক্স বিশপ ছিলেন।
এই পদ্ধতির আওতায়, প্রত্যেকটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষজন নিজেরা একটি মিল্লাত গঠন করতো। মিল্লাত শব্দটি এসেছে “জাতি” শব্দটির আরবী শব্দ থেকে, যা নির্দেশ করে যে ওসমানীরা নিজেদেরকে বহুজাতিগোষ্ঠীর মানুষদের রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করতো। প্রত্যেকটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে একেকটি স্বকীয় মিল্লাত হিসেবে বিবেচনা করায় গোটা সাম্রাজ্যে বহু মিল্লাতের অস্তিত্ব ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ওসমানী সাম্রাজ্যের সকল অর্থোডক্স খ্রিস্টানকে একটা মিল্লাত হিসেবে ধরা হতো, অন্যদিকে সকল ইহুদিদেরকে নিয়ে আরেকটি মিল্লাত ধরা হতো।
প্রত্যেকটি মিল্লাত তাদের ধর্মীয় নেতা নির্বাচন করার অধিকার রাখতো যিনি তাদের নেতৃত্ব দিতেন। অর্থোডক্স চার্চের ক্ষেত্রে (ওসমানী সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ চার্চ), কন্সট্যান্টিনোপোলের আর্চবিশপই ছিলেন অর্থোডক্স খ্রিস্টান মিল্লাতের ধর্মীয় নেতা। মিল্লাতের ধর্মীয় নেতারা তাদের ধর্মীয় আইন-কানুন নিজস্ব মিল্লাতের মানুষের উপর জারি করার অধিকার রাখতেন। ওসমানী সাম্রাজ্যের অমুসলিমদের উপর ইসলামী আইন (শরীয়াহ্) প্রয়োগ করা হতোনা।
অপরাধের ক্ষেত্রে, মানুষকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হতো, ইসলামী কিংবা অন্য ধর্মীয় আইন অনুযায়ী নয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন খ্রিস্টান যদি চুরি করতো, তাহলে তাকে খ্রিস্টান ধর্মের আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি দেয়া হতো। একজন ইহুদি যদি চুরি করতো, তাহলে তাকে ইহুদি ধর্মের আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হতো। শুধুমাত্র যেক্ষেত্রে ইসলামী আইন বিবেচনা করা হতো তা হলোঃ অপরাধী যদি মুসলিম হয়, অথবা অপরাধীরা যদি দু’টি ভিন্ন মিল্লাতের হয়। সেক্ষেত্রে, একজন মুসলিম বিচারক বিচারটি তদারক করতেন এবং তার বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ আইনের আওতায় বিচার করে রায় প্রদান করতেন।
ধর্মীয় আইনের পাশাপাশি, মিল্লাতগুলোকে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান (চার্চ, স্কুল ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠা এবং কর আদায়ের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। ওসমানী সুলতান শুধুমাত্র মিল্লাতের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে মিল্লাতকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। মিল্লাতের নেতারা সুলতানের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট পেশ করতেন এবং মিল্লাতের কোন সমস্যা দেখা দিলে সুলতান মিল্লাতের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করতেন। মিল্লাতের সংজ্ঞানুযায়ী, কাগজে কলমে ওসমানী সাম্রাজ্যের মুসলিমরাও একটি মিল্লাত প্রতিষ্ঠা করে, যার প্রধান ছিল স্বয়ং ওসমানী সুলতান নিজে।
সাফল্যধারা (Legacy)
ওসমানী সাম্রাজ্য টিকে ছিল ১২৯৯ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এর ইতিহাসের বেশীরভাগ সময় জুড়েই গোটা সাম্রাজ্যে মিল্লাত পদ্ধতি ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল। সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আরো অনেক মিল্লাত। আর্মেনীয়, ক্যাথোলিক, অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মিল্লাত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্যেকটি সম্প্রদায় আলাদা আলাদাভাবে অঞ্চলভিত্তিক চার্চে বিভক্ত ছিল।
গ্রীক সম্প্রদায়কে চার্চের মালিকানা দেয়া সংক্রান্ত ফাতিহ্ সুলতান মুহাম্মাদ এবং সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের রাজকীয় ফরমানসমূহ, এই ফরমানসমূহ এবং চার্চটি আজও ইস্তানবুলে টিকে আছে
মিল্লাত পদ্ধতি ওসমানী সাম্রাজ্যের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী ছিলনা। ১৮শ এবং ১৯শ শতকের দিকে সাম্রাজ্য যখন দুর্বল হওয়া আরম্ভ করে, ইউরোপীয় হস্তক্ষেপও বাড়তে থাকে। ১৯শ শতকে যখন উদারপন্থী তানিজমাত নীতি পাশ হয়, তখন ইউরোপীয় কায়দায় সেকুলার সরকার গঠনকে প্রাধান্য দিয়ে মিল্লাত পদ্ধতি বাতিল করা হয়। ওসমানীদেরকে বাধ্য করা হয় সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট সব “অধিকার” নিশ্চিত করতে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা বাড়ানোর বদলে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী সীমিত করে দিয়েছিল। নিজস্ব মিল্লাতের আইন-কানুন অনুসরণের পরিবর্তে, সকল মিল্লাতের লোকজনকে একই সেক্যুলার আইন অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এর ফলে গোটা সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হয়, যা ১ম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানী সাম্রাজ্যের শেষের দিনগুলোতে আর্মেনীয় গণহত্যার পিছনে একটি কারণ ছিল।
বহুজাতিক এবং বহুধর্মের অনুসারীদের নিয়ে গঠিত এক সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য মিল্লাত পদ্ধতি ছিল এক অনন্য এবং সৃষ্টিশীল সমাধান। এই পদ্ধতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদেরকে যে অধিকার এবং স্বাধীনতা দিয়েছিল, তা ছিল সে সময়ের চেয়েও অনেক অনেক অগ্রগামী। ২০শ শতক পর্যন্ত ইউরোপ যখন ধর্মীয় নিপীড়ন সমস্যার সমাধানের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিল, এর বিপরীতে ওসমানীরা তৈরী করেছিল এক এবং স্থিতিশীল ধর্মীয় বহুজাতিক পদ্ধতি যা শত শত বছর ধরে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে এসেছিল।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ Non-Muslim Rights in the Ottoman Empire আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ জাহ্রা বিনতে মুহাম্মাদ
Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ
Itzkowitz, Norman. Ottoman Empire And Islamic Tradition. Chicago: University Of Chicago Press, 1981. Print.
Ochsenwald, William, and Sydney Fisher. The Middle East: A History. 6th. New York: McGraw-Hill, 2003. Print.
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন