আবু সামিহাহ সিরাজুল ইসলাম
ইরানে এখন কিছু সরকার বিরোধি বিক্ষোভ হচ্ছে। এতে করে কিছু লোকজন খুব আনন্দিত। তাঁরা মনে করছেন ইরানে সরকার পতন হবে এবং এতে শিয়া মতবাদের ধ্বংস হবে। তাঁদের মনে রাখা দরকার যে এটা সে রকম কোন সরল সমীকরণ নয়।
ইরান বিপ্লব যে বছর হয় সে বছর (১৯৭৯) আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। বিপ্লবের পরপরই (১৯৮০) আরব জাতীয়তাবাদী/সমাজতন্ত্রী সাদ্দাম হুসেইন ইরান আক্রমন করে। [উল্লেখ্য যে সাদ্দাম হুসেইন ছিলেন মিশেল/মাইকেল আফলাক্ব [Michael Aflaq] নামক আরব খৃষ্টানের হাতে গড়া বা‘স (البعث) পার্টির (পুরো নাম হিজ়ব আল-বা‘স আল-আরাবী আল-ইশতিরাকী – حزب البعث العربي الإشتراكي) ইরাকী শাখার নেতা; এই পার্টির উদ্দেশ্য ছিল আরবদেরকে সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা]। আমার বাপ ছিলেন জাহাজী মানুষ। উনার জাহাজ তখন শাতিল আরবে। প্রতিদিন ইরানী ও ইরাকী বোমারু বিমানের বোমা হামলার ভয়ে ভয়ে থেকে শেষে পারশ্য উপসাগর থেকে কোন মতে বেরিয়ে আসেন। দেশে আসার পর থেকে দেখলাম ইরানের বিরুদ্ধে ও সাদ্দাম হুসেইনের পক্ষে বহুৎ কথা বলছেন। সম্ভবত এই কারণে যে উনার জাহাজ ছিল শাতিল আরবের ইরাকী প্রান্তে। সেজ মামা ছিলেন বাউণ্ডেলে টাইপের মানুষ। সব মামারা ঢাকায় থাকলেও উনার কোন সুনির্দিষ্ট ঠিক ঠিকানা ছিল না। তারপর দেখা যেত উনি হঠাৎ বলা কওয়া ছাড়া কোন একদিন সন্ধ্যায় সন্দ্বীপে আমাদের বড়িতে হাজির হয়ে গেছেন। মামাদের মধ্যে এজন্য আমরা সেজ মামাকেই সবচেয়ে বেশি দেখতাম। সেজ মামা আসার পর আব্বার সাথে তর্ক লেগে গেল। দেখলাম তিনি ইরানের সমর্থক। ইরান বিপ্লব কেন হয়েছে এবং সাদ্দাম হুসেইনের সমস্যা কী - সে সমস্ত বিষয়ে কথা বলেছেন। সেই থেকে ইরানি বিপ্লবের সাথে পরিচয়।
ইরানী বিপ্লব এক সময় ইসলামী বিপ্লবাকাংখীদের অনেকের কাছেই এক ধরণের মডেলে পরিণত হয়ে যায়। একটা অজনপ্রিয় ও পশ্চিমের তাঁবেদার রাজতান্ত্রিক সরকারকে জনগণ স্বতস্ফূর্ত বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে একটা রিপাবলিকান সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে তিনটা দেশে মোটামুটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার আছে। ইরান তাদের একটা। সে বছরই সেই সরকার উৎখাত ও আমেরিকান জিম্মিদের উদ্ধারে পাঠানো আমেরিকান মিশনের [Operation Eagle Claw] ব্যর্থতা বিপ্লবকে আরো জনপ্রিয় করে। তারপর ইরাকের সাথে ৯ বছরের যুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে বেশ কয়েকবার ইরানের পার্লামেন্টে বোমা হামলা, প্রেসিডেন্ট হত্যা, ইত্যাদির পরেও ইরানের নতুন সরকার টিকে যায়। ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ছাড়াও ইরান থাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বয়কট ও বিভিন্ন চাপের মুখে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইরান শাহের রাজতান্ত্রিক সময়ের স্থবিরতাকে পেছনে ফেলে মানব উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপক উন্নতি সাধন করে। শিক্ষা-দীক্ষা [নারী শিক্ষা সহ], বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈলের পরেই নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে। পশ্চিমারা ইরানের যে সম্পদ শাহের আমলে কুক্ষিগত করত তা আর করতে পারে না।
বিপ্লব পরবর্তী ইরান সাংস্কৃতিকভাবেও প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বব্যাপী। আমার মনে পড়ে ইরানী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে একটা নিউজলেটার মত বের হত, যা প্রায় ইসলাম পসন্দ ব্যক্তিদের ঘরে পাওয়া যেত। ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং আল-কুদস মুক্তকরণের প্রোপাগাণ্ডাও ইরানীরা চালায়। ফলে মুক্তিকামী মানুষদের কাছে ইরান প্রিয় হয়ে উঠে। এ দিকে ইরান লেবাননে শিয়াদের মধ্য থেকে তাদের চিন্তাধারার আদলে হিজ়বুল্লাহ নামে নতুন একটা দল গড়ে তোলে। উল্লেখ্য লেবাননে মূল শিয়া দল ছিল “আমল”। হিজ়বুল্লাহ বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং তাদের কারণেই শেষ পর্যন্ত ইসরাঈল দক্ষিণ লেবাননের দখলদারিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়। আর দক্ষিণ লেবাননের যুদ্ধে ইসরাঈল হিজ়বুল্লাহর হাতে বেশ নাজেহাল হয়েছে।
ইরানের এ সমস্ত বিষয়গুলোকে আপনাকে আমাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। আপনি কোন জাতি বা গোষ্ঠিকে পসন্দ করেন বা না করেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু যদি তাদেরকে মূল্যায়ন করতে না শিখেন তবে মুশকিলে পড়বেন। আমি অবশ্যই শিয়া মতবাদের সমর্থক না। শিয়া মতবাদের ত্রুটিগুলো নিয়ে আমি বিভিন্ন সময়ে লিখেছিও। সেই ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে আমার চারপাশের মানুষজনকে সতর্ক করার কাজও আমি নিয়মিত করি। কিন্তু ইরান যে একটা টেকসই [viable] রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সিস্টেম গড়ে তুলেছে তাকে মূল্যায়ন [appreciate] ও শ্রদ্ধা [admire] অবশ্যই করতে হবে।
এখন আসি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের কথায়। ইরানে যতদিন রাজতন্ত্র ছিল এরা ততদিন তাদের বিরুদ্ধে কোন টু শব্দটিও উচ্চারণ করে নি। বিপ্লব পরবর্তী ইরানের বিরুদ্ধে তারা লেগেছে। তারা আরব জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রী সাদ্দামকে দিয়ে ইরান আক্রমন করিয়ে তাকে প্রচূর অর্থ সহযোগিতা করেছে। শেষ পর্যন্ত সাদ্দাম তাদের নিজেদের জন্যই কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। তাদের নিযুক্ত করা বেতনভূগ দা’ঈরা শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে লিখালিখি ও বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। মুশকিল হল তাদের এসমস্ত কর্মে ইরান পিছিয়ে পড়ে নি এবং শিয়া মতবাদও দূর্বল হয়ে যায় নি; ইরানীদের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে বরং অনেক বেড়েছে। এদের শিয়া বিরোধি ভূমিকা মূলত বিপ্লবী ইরানকে ভয় ও নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। বেশ অনেক মুসলিম তরুণরা ইরানের প্রতি দূর্বলতা অনুভব করে ইরানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভূমিকার কারণে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্ত পেটমোটা টাকাওয়ালা ও মুসলমানদের ঘাড়ে চেপে বসা মোটাবুদ্ধির রাজা বাদশাহরা যদি সত্যি শিয়া মতবাদ ও ইরানী প্রভাব রোধ করার সদিচ্ছা রাখতেন তবে তাদের কর্মপন্থা হত ভিন্ন। তারা মনে করে টাকা দিয়ে তারা সব কিছু পরিবর্তন করে ফেলবে, যা অসম্ভব। তাদের সদিচ্ছা থাকলে তারা তাদের নিজেদের দেশে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার চালু করার ব্যবস্থা নিত [মুরসীর নির্বাচিত সরকারের জন্য সহায়তা হতে পারত তাদের জন্য তাদের জনগণের কাছে মর্যাদার ও সম্মানের] , গবেষণা ও উন্নয়নে [research and development] অর্থ ব্যয় করে কারিগরি ক্ষেত্রে পশ্চিমের উপর নির্ভরতা কমাতে পারত, তাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যায়োনিস্ট ইসরাইলের প্রতিরোধকারী শক্তিগুলোর সহায়ক হতে পারত। এসব করলে বিশ্ব মুসলিমদের চোখে তাদের মান-মর্যাদা বাড়ত। তখন বেতনভূগ হুজুরদের দিয়ে শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে লিখালিখি ও বক্তৃতা বিবৃতি দেয়ানোর কোন দরকার হত না। মানুষ আপনা-আপনিই তাদের দিকে ঝুঁকে থাকত এবং কোনভাবেই ইরানী প্রভাবে প্রভাবিত হত না। কিন্তু এই মাথামোটাগুলা দেশ, জনগণ ও ইসলামের চেয়েও নিজেদের ব্যক্তিগত ক্বায়েমী স্বার্থকে দেখে আগে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
এখন ইরানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দেখে লাফালাফির কিছু নাই। বিক্ষোভকারীগুলার বেশিরভাগই হল হিপ্পি টাইপ চরম সেক্যুলার ও ইরানী জাতীয়তাবাদী। আমি চাই যে এদেরকে দমন করা হবে এবং ইরানের সরকার টিকে থাকবে; এবং সম্ভবত তাই হবে। ইরানী প্রভাব মুক্বাবিলা করতে হলে আরব সুন্নী(?) শাসকদেরকে অবশ্যই জনগণের শাসক হতে হবে এবং ইরানীদের মতই নিজেদেরকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করতে হবে; আর পশ্চিমের পদলেহন করা ও নিজেদেরকে জনগণ, দেশ ও এর সম্পদের মালিক মনে করার ধারণা পরিত্যাগ করে তাদের প্রতিনিধি হতে হবে। শুধুশুধি শিয়া মতবাদের জুজু দেখিয়ে কোন লাভ হবে না, কারণ শুধু কথায় চিড়া ভিজে না। কিছু দালাল যোগাড় করা ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।
পুনশ্চঃ ইরানের সরকার টিকে থাকার আকাঙ্খা করা মানে শিয়া মতাবলম্বী হওয়া নয়। আমাদের যে সমস্ত বন্ধুরা শিয়া মতবাদকে শুধু একটি রাজনৈতিক ফিরক্বা মনে করেন তাদের সাবধান হতে বলব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন