সাইয়েদ মাহফুজ খন্দকার
আশির দশক থেকে আমার পরিবারের সদস্যরা দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের সাথে যুক্ত। আব্বু চিল্লা দেন সেই আশির দশকেই। আব্বুর পর কাকা জেঠারা যুক্ত হোন এই মেহনতের সাথে। দাওয়াতের মেহনতেই আমাদের 'সাংস্কৃতিমনা' পুরো পরিবারটি হয়ে যায় 'দ্বীনদার পরিবার'।
হারমুনিয়ামের তালীমের বদলে বাসায় শুরু হয় ফাজায়লে আমলের তালীম। সেই আশির দশক থেকেই তালীম চলছে। আম্মু আমাদের কোলে বসিয়েই ফাজায়েলে আমলের তালীম করতেন......
বুঝ হবার পর থেকেই তালীমে বসতাম প্রতিদিন। সপ্তাহে একদিন বাড়ির সবাই মিলে তালীমে বসতেন বড় ফুফুদের ঘরে। এমন অনেক স্মৃতি।
'ছয় নাম্বার' তো অনেক ছোট থেকেই মুখস্ত! কয়কটি গুণের আমল করিয়া চলিতে পারিলে দ্বীনের ওপর চলে অতি সহজ। গুণ কটি হচ্ছে, কালিমা, নামাজ......
দাওয়ায়তের মেহনতের উচিলায় আব্বু আমাদের পরিবারের বেশীরভাগ সদস্যদের মাদরাসায় ভর্তি করান। আমার বড় ভাইয়াকে ৫ বছর বয়সেই ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় আবাসিক মাদরাসায়। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন হয়.........
আব্বু দেশের বাহিরে, কাকা অন্য জেলায় চলে যাওয়ার কারনে পারিবারিক ভাবে মেহনতের জিম্মাদারি আসে ভাইয়ার ওপর। খুব কম বয়সেই ভাইয়ার দ্বারা অনেক মেহনত হয়েছিলো। চিল্লা দিয়েছিলেন এলাকার 'টপ' 'টপ' নেতারা।
ভাইয়া এলাকা থেকে চলে যাওয়ার পর মাঝখানে আবার একটু গ্যাপ। এরপর পারিবারিক ভাবে এলাকায় মেহনতের জিম্মাদারি আসে 'আমাদের' ওপর।
আমার প্রথম দাওয়াতে মেহনতে সময় লাগানো হয় ২০০৮ সালের দিকে। এর আগে অবশ্য আমি ইজতেমায় গিয়েছি। ৩ দিন দেয়ার পর থেকেই নিয়মিত মেহনতের সাথে যুক্ত থাকতাম। এলাকায় ও বাজারে, দুই মসজিদে তালীমের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। এলাকায় আসরের পর, আর বাজারে এশার পর।
সাথী কম ছিল এলাকায়, তাই তিন দিনের সাথী হয়েও 'রোখ' দেয়ার মত জিম্মাদারি'র দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল সে সময়।
এলাকার একজন জিম্মাদার সাথী ছিলেন, নাম দিলওয়ার ভাই। তিনি চাইলেন আমি যেন চিল্লা দিয়ে আসি। কিন্তু পরিবার চাইছিল 'নিয়ম মেনে' যাই। কিন্তু আমার যে যেতেই হবে চিল্লায়। ২০০৯ সালে চিল্লা দেওয় হয় প্রথম।
প্রথম চিল্লা শেরপুরের শ্রীবরদীতে। স্মরণীয় চিল্লা। সব সাথির নাম এখনো মনে আছে। কয়কদিন আগেও দুইজন সাথির সাথে দেখা। তারা অবশ্য চিনতে পারছিলেন না, তখন প্যান্ট-শার্ট পরা দাড়ি না উঠা মোটা সাথিটা যে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে! তাই না চেনারই কথা। কিন্তু আমি চিনতে পেরেছি। কথাও হয়েছে।
পরের চিল্লাগুলো সেইভাবে স্মরণীয় ছিল না। প্রথমটার মজাই ছিল আলাদা। চিল্লা থেকে এসে খুব মেহনত চলে এলাকায়। ৮ ঘণ্টা মেহনত, গাস্ত, তালীম, আড়াই ঘণ্টা মেহনত। ইত্যাদি।
আমার এলাকা ও বাজারের মসজিদ, দুইটাতেই খুব কাজ হলো। নতুন অনেক সাথী চিল্লায় গেলো। বিশাল বিশাল ৩ দিনের জামায়াত বের হলো। এক কথায় জমজমাট কাজ।
স্বভাব অনুযায়ী বড়দের সাথে একটা সম্পর্ক হয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কাকরাইলের তাহের ভাই, যিনি ইজতেমার ময়দানে ইলেকট্রিক জামায়তের একাংশের জিম্মাদার, তার সাথে পরিচয় হয়েছিল। একবার ইজতেমায় প্রায় ১৭/১৮ দিন ছিলাম ইলেকট্রিক জামায়তের সাথে। অসাধারণ ছিল সেই সময়টা। সে সময় দুই ইজতেমার মাঝের সময়টায় ময়দানের মাসওয়ারার কামরায় আহমদ লাট সাহবের খাস বয়ান শুনেছিলেম। আনুমানিক ১০০ জন সাথী ছিল। এর মধ্যে মাওলানা সা'দ সাহেব, জুবায়েরুল হাসান রহঃ-সহ সব মুরব্বী ছিলেন। এক সাথে বসেই বয়ান শুনার সুযোগ হয়েছিল।
যেহেতু আমি চট্টগ্রামের, তাই চট্টগ্রামের জিম্মাদার সাথিদের সাথেও ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। বিশেষ করে মাওলানা মুহিউদ্দিন সাহেব, মাওলানা ইনআমুল হাসান সাহেব, সরওয়ার ভাই, শাহিন ভাই, আসগর ভাই, ইউসুফ ভাই, সুলতান ভাইসহ অনেকে। অনেক স্মৃতি......
আমি এলাকা থেকে চলে আসার পর পারিবারিক ভাবে এলাকার মেহনতের জিম্মাদারি এখন পালন করছে ছোট জেঠাতো ভাই ইলিয়াস ও অন্যরা। আমার তুলনায় তার কাজের বরকত অনেক অনেক বেশি হচ্ছে। যারা একসময় আমাকে গাস্তে করতে দেখলে তিরস্কার করত, সেই লোকগুলোই এখন ৩ দিন করে জন্য সময় লাগাচ্ছে! নিয়মিত তালীমে বসছে। আল্লাহু আকবার!
তবে একটা বিষয় সেই শুরু থেকেই আমার কাছে আপত্তিকর মনে হতো। তা হচ্ছে, জিম্মাদার সাথি ভাইগণ আলেম-উলামাদের সহ্য করতে না পারা। এটা খুব সহজে বুঝা না গেলেও জিম্মাদার সাথিদের সাথে কিছুদিন চলা ফেরা করলেই স্পষ্ট হয়ে যেতো।
লাভলেইনে তখন পটিয়ার নুরুল ইসলাম জদিদ সাহেব হুজুর (রহঃ) নিয়মিত আসতেন। আর হাটহাযারীর মুফতী জসিম সাহেব তো ছিলেনই। কিন্তু গায়রে আলেম জিম্মাদারগণ আলেম সাথিদের মোটেও পছন্দ করতে না। সমালোচনা তো নিয়মিত আমলের মত করে করতেন।
এক সাথির বড় অভিযোগ ছিল যে, আল্লামা শফী সাহেব হুজুর কেন চিল্লা দেন না? এই অভিযোগ তিনি প্রায় করতেন। সমস্যাটা যে নতুন না, তা বুঝতে পারি বাংলাদেশের দাওয়াতে তাবলীগের প্রবীণতম মুরব্বী মাওলানা ইউসুফ শাহনগরী সাহবকে দেখে। তিনি দীর্ঘ ১২ বৎসর জিম্মাদারি করেছেন ইজতেমায়। পৃথিবীর বহু দেশে তিনি প্রথম জামায়াত নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু একটা সময় এসে এসব 'বে-উচলি' দেখে তিনি সরে পরেন। কাকরাইল থেকে মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব গিয়েছিলেন ওনাকে নিয়ে আসতে, তিনি আসেননি। গত কয়েক মাস আগে তিনি ইন্তেকাল করেন।
যাইহোক; দাওয়ায়তে তাবলীগের সাধারণ জিম্মাদার সাথিদের মধ্যে আলেম বিদ্বেষ যে অনেক পুরনো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
২০১১ সালের কথা। ওয়াসিফ ভাই লাভলেইনে বয়ান করছিলেন, বয়ান তিনি ভাল করেন কোন সন্দেহ নেই। বয়ান চলা অবস্থায় পুরনো কিছু সাথিকে ওনার সমালোচনা করতে দেখলাম। সমালচনার বিষয় ছিল_ ওয়াসিফ ভাই ছেলে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন টাকা কামানোর জন্য.... ইত্যাদি। সাধারণ ভাবে মনে হতে পারে এটা কোনো সমালোচনার বিষয় হলো নাকি? ছেলে আমেরিকা পাঠাতেই পারেন তিনি। কিন্তু যারা তাবলীগের নিয়মিত সাথী, তারা বুঝবেন, একজন জিম্মাদার, যিনি নিয়মিত বয়ান করেন দুনিয়া ছেড়ে এখেরাতের কাজে লেগে পড়তে, তিনিই যদি ছেলেকে আমেরিকায় পাঠান, তাহলে তো কথায় কাজে-মিল থাকে না!
যাক, এর পর প্রোফেসর মুশফিক স্যারের সাথে ওয়াসিফ ভাইয়ের সমস্যা তৈরি হয়। ওয়াসিফ ভাইয়ের বিষয় একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ জানিয়েছেন মুশফিক স্যার। কিন্তু অদৃশ্য কারনে ওয়াসিফ ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যানা যায়, তখন থেকেই মাওলানা সা'দ সাহেব ওয়াসিফ ভাইকে সমর্থন দিয়ে আসছে। আর এ কারনেই তাঁর বিরুদ্ধ কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এটাও ঠিক যে, মুশফিক স্যারের কর্মকাণ্ডও দ্বীন মেনে হয়েছিল বলে আমি মনে করি না।
ওয়াসিফ ভাইয়ের সাথে মুশফিক স্যারের সমস্যা যখন চূড়ান্ত পর্যায়, তখন কাকরাইলে বড় ধরণের গণ্ডগোল হয়। খুনোখুনি হয়। গণহারে জঙ্গি বলে গ্রেপ্তার করিয়ে দেয়া হয় মুশফিক স্যারের অনুসারীদের। ইজতেমার ময়দানেও সমস্যা তৈরি হয়। সেখানেও মারামারি-কাটাকাটি হয়। গ্রেপ্তার হতে হয় মুশফিক স্যারের লোকদের। তবে তখন থেকেই ওয়াসিফ ভাইয়ের লোকেরা শক্তিশালী। তাদের কেউ 'হারাতে' পারে না।
এবার আসি ইনসাফের বিষয়-
২০১৪ সাল থেকে দেশের প্রথম ইসলামী ঘরানার মিডিয়া হিসবে কাজ করে যাচ্ছে ইনসাফ। স্বাভাবিক ভাবেই ২০১৪ সালে মুশফিক স্যার ও ওয়াসিফ ভাইয়ের গণ্ডগোলের সময় ইনসাফের অবস্থান ছিল ইসলামী ঘরানার মিডিয়ার মধ্যে 'একক'। ওইসময় অনেকে নিউজ পাঠিয়েছেন তাবলীগ ইস্যু নিয়ে। সেই ভাবে গুরুত্ব দিয়া না হলেও কয়েকটি পত্রিকায় এসবের নিউজ এসেছিলও। তবে ইনসাফ নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এসব বিষয় ইনসাফে কোন নিউজ হবে না।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে মাওলানা সা'দ সাহেবকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তাঁর কিছু বক্তব্যের বিষয় দারুল উলুম দেওবন্দের কাছে কেউ জানতে চাইলে, দেওবন্দের ফতওয়া বিভাগ থেকে এর সঠিক জবাব দেয়া হয়।
এ বিষয় ভারতের একটি উর্দু দৈনিক খবর প্রকাশ করে। দেওবন্দে থাকা কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্র এটা অনুবাদ করে আমাদের কাছে পাঠায়। যেহেতু দাওয়াতে তাবলীগ ইস্যুতে আমরা কিছু প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই কোন ভাবেই এসব প্রচার করা হয়নি ইনসাফে।
অনেকের মনে প্রশ্ন; কেন আমরা দাওয়াতে তাবলীগ বিষয় কোন নিউজ বা পক্ষে-বিপক্ষে কোন মতামত তুলে ধরিনি? আমাদের উত্তর হচ্ছে; আমরা মনে করি এসব ঘরের বিষয়। এসব নিয়ে বাহিরে আলোচনা না করা উত্তম। সমস্যাগুলোকে নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই সমাধানের চেষ্টা করাকে আমরা উত্তম মনে করেছি, এবং এখনো করি। তাই 'অনেক কিছু' সবার আগে জানলেও আমরা বরাবরের মত এড়িয়ে গেছি। আমাদের এই এড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তি স্বার্থে বা ব্যক্তি পছন্দের কারনে নয়। আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করিনি উম্মতের বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে। আমরা এখনো মনে করি এসব বিষয় মিডিয়ায় আলোচনা আনা উচিৎ নয়। এবং আমরা এটাও মনে করি যে, আজকে সমস্যাটা এতো বড় হওয়ার পিছনে কিছু মিডিয়ার ভূমিকা ছিল......।
ইনসাফ এসব নিয়ে এখনো চুপ রয়েছে। বরাবরের মত পাঠকের চাহিদা থাকলেও বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে আমরা এখনো এসব বিষয় চুপ রয়েছি। আমরা আশা করছি, অচিরেই আল্লাহর দ্বীনের এই উত্তম মেহনতটাকে আল্লাহ ফিতনা মুক্ত করবেন। তবে একেবারেই যদি সমাধান না হয়, তাহলে ভিন্ন চিন্তাও আমাদের করতে হতে পারে......
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন