পেশাগত জীবনে রেজাউল হায়াতের মতো ডাকাবুকো সচিব কমই দেখেছি। সুদর্শন। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। সব বিষয়ে জানাশোনা। মুক্তিযোদ্ধা এই সচিব এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) হিসেবে কাজ করেছেন। বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর জেলা প্রশাসকও ছিলেন। এখনো পর্যন্ত সর্বাধিক সময় পর্যন্ত যোগাযোগ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের রেকর্ড প্রয়াত রেজাউল হায়াতেরই। আমি তখন প্রথম আলোতে কাজ করি। বয়সে একেবারে তরুণ। তবে ঝানু আমলা রেজাউল হায়াতের সাথে সখ্যতা তৈরি হয়ে যায় অনায়াসেই। কারণে, অকারণে সচিবালয়ে রেজাউল হায়াতের রুমে ঢু মারি। কাজের কথা হয়, ঠুকটাক গল্পও। এভাবেই দাপুটে সিএসপি হয়ে যান ‘ভাই’। অফিসের বাইরেও দু’চারবার দেখা হয়। খাওয়াতে ভালোবাসেন। পেশাদারি সম্পর্কের বাইরে যে এভাবে দ্রুত ভাই আর বন্ধুর মতো রেজাউল হায়াত মিশে যাবেন ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। কিন্তু সেই রেজাউল হায়াতের অনুরোধও রাখতে পারিনি।
যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে সড়ক উপদেষ্টা কাউন্সিলের বৈঠক। বৈঠকের সভাপতি মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টারদের চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সাধারণত এসব অনুষ্ঠান কাভার করতে আমন্ত্রণপত্র সঙ্গে নিতে হয়না, আমরাও নেইনা। কিন্তু কি মনে করে যেন আমি ওইদিনই আমন্ত্রণপত্র সাথে রেখেছি।
বৈঠক সবে শুরু হবে। সড়ক উপদেষ্টা কাউন্সিলের সকল সদস্য এসেছেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা আছেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সদস্যরাও আছেন। আচমকাই মন্ত্রী জানতে চাইলেন, এখানে জনকন্ঠের কেউ আছেন? রাশেদ মেহেদী উঠে দাড়ালেন। সালাম জানালেন। জনকন্ঠের রিপোর্টার। রাশেদকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী নাজমুল হুদা খানিকটা রাগত স্বরে বললেন, আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যান। সবাই হতবাক। রাশেদ মেহেদী ইতিউতি তাকাচ্ছেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না যেন।
মুখ খুললাম আমি। কি ব্যাপার! জনকন্ঠের রিপোর্টার কেন বেরিয়ে যাবে? মন্ত্রী বলছেন, ওরা উল্টাপাল্টা লেখে।
আমি: আপনি প্রতিবাদ করেন।
মন্ত্রী: প্রতিবাদ ঠিকমতো ছাপেনা।
আমি: তাহলে প্রেস কাউন্সিলে যান।
মন্ত্রী: সে তো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
আমি: তাই বলে আমন্ত্রণ জানিয়ে আপনি গণমাধ্যম কর্মীকে মিটিং থেকে বের করে দেবেন?
মন্ত্রী: না, জনকন্ঠের সাংবাদিক এখানে থাকতে পারবে না।
আমি: জনকন্ঠের সাংবাদিক এখানে থাকবে না। আমরাও কেউ এখানে থাকবো না। আপনাকে (মন্ত্রী নাজমুল হুদা) বয়কট করছি সাংবাদিকরা। দাড়িয়ে পড়লাম এবং সকল সাংবাদিককে আহ্বান করলাম যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়তে। একযোগে সবাই বেরিয়ে পড়লাম, সভা কার্যত ভন্ডুল হওয়ার মতো। সচিবসহ আরো কয়েকজনও বেরিয়ে পড়েছেন, মন্ত্রনালয়ের করিডোরে। আমরা খানিকটা উত্তেজিত। হতভম্ভ তো বটেই। রেজাউল হায়াত এসে জড়িয়ে ধরলেন। রীতিমতো করুণ সুর। ‘আরিফ, ভাই আমার। প্লিজ আমার ইজ্জতটা রক্ষা করেন। এভাবে বয়কট করে চলে গেলে আমাদের সুনাম থাকবেনা। এই কাজটি করবেন না। যা হবার হয়ে গেছে। আমরা দু:খিত। সভাকক্ষে চলুন।’ বললাম, আমরাও দু:খিত। যেভাবে সবার সামনে একজন গণমাধ্যম কর্মীকে বের করে দিতে চাওয়া হলো সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কর্মকর্তারাও তা অনুসরণ করবেন। আমরা আপাতত বয়কটেই থাকবো। সচিবের অনেক পীড়াপীড়িতেও আমরা অনড় রইলাম। যোগাযোগ মন্ত্রীকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে মিডিয়ায় বয়কট বা বর্জনের খবর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হলো আর পরদিন প্রকাশিত হলো বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে।
মন্ত্রী পিএস আবু তালেব। সদালাপী কর্মকর্তা। মিডিয়া কর্মীদের সাথে ভালো যোগাযোগ। পরদিন মুঠোফোনে ধরলেন। ভাই, এটা কেমন হলো! কোনটা? পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাইলাম। ওই যে, মন্ত্রী মহোদয়ের সংবাদ বর্জন করবেন আপনারা। ওহ, তাই বলেন। আমি বললাম, কিছুই করার নেই। এট চলবে। কিছু করা যায়না? আবু তালেব জানতে চান। বলেন, বিষয়টির সুরাহা করা যায়না? বললাম, হয়তো যায়। যদি যোগাযোগ মন্ত্রী, দু:খ প্রকাশ করেন। ওইদিন যেসব সংবাদকর্মী ছিলেন তারা যদি বিষয়টি মেনে নেন তো সুরাহা হতে পারে। মন্ত্রীর দক্ষ পিএস আবু তালেব খানিকটা বিস্মিতই হন যেন। বলেন, কি যে বলেন না! আমি বলি, হ্যাঁ এটাই এক এবং একমাত্র রাস্তা। কথাবার্তা এভাবেই শেষ হয়। একদিন, দু’দিন। এভাবে সপ্তাহ পার হয়। যোগাযোগ মন্ত্রীর খবর টেলিভিশনে প্রচার হয়না। খবরের কাগজেও প্রকাশিত হয়না। মন্ত্রী নাজমুল হুদা ভেতরে ভেতরে নাখোশ। পিএস আবু তালেব আবার ফোন করেন। কি ভাই রাগ কি একটু কমেছে? বলি, আপনার সমস্যাটা কি? এখানে রাগ, অনুরাগের কিছু নেই। আমার কমিউনিটির সম্মান আমার কাছে সবচেয়ে বড়। ঘুরেফিরে পিএসের একই কথা ভাই সুরাহা দরকার। সাফ বললাম, যদি মন্ত্রী সড়ক উপদেষ্টা কাউন্সিলের বৈঠকে উপস্থিত সকল সাংবাদিকের কাছে দু:খ প্রকাশ করেন এবং সবাই যদি মেনে নেন তাহলেই সুরাহা। এছাড়া এনিয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা নেই।
সঙ্গত কারণেই যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের খবর করেন এমন রিপোর্টাররা ওই ঘটনায় সাংবাদিকদের সম্মান রক্ষায় আমার ভূমিকায় খুশি ছিলেন। সবাই তাই পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটি অনেকটা আমার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। জাদরেল মন্ত্রীর পিএস আবু তালেব বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন নাজমুল হুদার সঙ্গে। পিএস আবার মুঠোফোনে আমাকে জানালেন, ভাই আপনারই জয় হলো। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, তিনি দু:খ প্রকাশ করবেন। আমি বললাম, ভাইরে এই দু:খ প্রকাশ কিন্তু টেলিভিশনে প্রচার হবে। যা করবেন, বুঝেশুনে করবেন। এটি হলে আছি, নইলে না। পিএস বললেন, ‘স্যার (মন্ত্রী নাজমুল হুদা) সব কিছুতেই রাজি। আমি সবাইকে আগামীকাল সকাল ১০ টায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। প্লিজ আপনি একটু দেইখেন।’ আমি বললাম, দেখার কিছু নেই। আপনি সবাইকে বিষয়বস্তু জানিয়ে আমন্ত্রণ জানালে নিশ্চয়ই কাজ হবে।
দু:খ প্রকাশের জন্যে নাজমুল হুদা যোগাযোগ মন্ত্রীর জন্যে বরাদ্দকৃত সচিবালয়ের নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানালেন। মন্ত্রীর পিআরও থাকলেন দর্শকের ভূমিকায়। মন্ত্রী নিজে এবং পিএস সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করলেন। সাংবাদিকরা আমরা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে কথা বললাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম যাবো। রুমে ঢুকতেই নাজমুল হুদা দরাজ কন্ঠে বলে উঠলেন, ভাইরে আমি তো আসলে কিছু মিন করে বলিনি। এরপর সবাইকে নিয়ে বসলেন এবং বললেন, ‘ওইদিনের ঘটনার জন্য আমি দু:খিত। কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী’। নাজমুল হুদা আরও বললেন, তাঁর শিক্ষা হয়েছে। এ ধরনের কাজ ভবিষ্যতে তিনি করবেন না।
পরে কোন এক ফাঁকে ঢুকলাম সচিবের কক্ষে। আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন, পারেন বটে! শাবাস!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন