জাহিদ আল আমীন
দমকা হাওয়ার মতো হঠাৎ করে আসা মোদি ঝড়ে মহান ভারতবর্ষে বামদের সর্বশেষ দুর্গের পতন হয়েছে! গেরুয়া ঝড়ে ধুলিসাৎ ত্রিপুরার লাল দুর্গ। পদ্মফুলের এই বিজয় কেতন অপ্রত্যাশিত হলেও আগরতলার বাসিন্দাদের কাছে এটাই এখন বাস্তব।
গৌরবময় চরম অনিশ্চয়তার নাম রাজনীতি। জনস্রোত কখন, কোন দিক দিয়ে কীভাবে যে বইবে, কিছুটা আঁচ করা গেলেও ঠিক ঠাক ঠাহর করা মুশকিল। রাজনীতির অমসৃণ পথে ক্ষণে ক্ষণে বাঁক থাকে। এর পরতে পরতে চমকও আছে। এখানেই রাজনীতির খেলা। মজাটাও এখানে। তবে নতুন যেকোন কিছুর মাঝে যেমন আনন্দ, উল্লাসের জোয়ার আছে, তেমনি কখনো কখনো শোকের ছায়া, বিষাদের অন্ধকারও নেমে আসে। যেমনটি এসেছে বাংলাদেশের প্রতিবেশি ক্ষুদ্রতম ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরায়।
ত্রিপুরায় সুদীর্ঘ দৃই দশকের হাতুড়ি-কাস্তের শাসনামল এখন ইতিহাস।পরাজিতের প্রতি অন্ধ আক্রোশে সেখানে লেলিনের মুর্তিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে গেরুয়ারা। সিপিএম পার্টি অফিস, নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘর জ্বলছে দাউদাউ। সেই আগুণের লেলীহান শিখা দাবানলের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেও ছড়িয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি ছড়িয়েছে একজন আত্নতাগী মানুষের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি। পুঁজিবাদের এই যুগে, বিলাসী এই সমাজে এমন মানুষও আছেন, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়!
তিনি মানিক সরকার। সদ্য পরাজিত ত্রিপুরার সিপিএম দলের নেতা ও সাবেক মূখ্যমন্ত্রী। ১৯৯৮ সালের মার্চ মাস থেকে বিগত কুড়ি বছর যাবৎ তাঁর কাধেই ছিলো ত্রিপুরার নেতৃত্ব। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই বোকা (!) মানুষটির নিজের কোন বাড়ি নেই, নেই কোন গাড়ি। ব্যাংকেও নেই কাড়ি কাড়ি টাকা। মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার টাকার পরিমাণ ক্রমাগত কমেছে। তার ঘোরতম কোন শক্রুও তার বিরুদ্ধে কোন ধরণের অনিয়ম, দুর্ণীতি ও স্বজনপ্রীতির কোন অভিযোগ আনতে পারে নি।
আগরতলার কাছে মানিক সরকারের ৯০০ বর্গফুটের একটি পৈতৃক বাড়ি আছে, যেটি কাঠের তৈরি। সে বাড়িতে নিজের প্রাপ্য ৪৫০ বর্গফুট বোনকে দিয়েছেন। এতো বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরেও সে বাড়িতে কোন পরিবর্তন আনেন নি।
নির্বাচনে পরাজিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নেবার পর স্ত্রীকে নিয়ে এক রুমের দলীয় গেস্ট হাউসে উঠেছেন। পার্টি অফিসে যা রান্না হবে মানিক সরকার সেটাই খাবেন।
অারও অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, এই কুড়ি বছরে মানিক সরকারের স্ত্রী পঞ্চালি ভট্ট্রাচার্য এক মুহূর্তের জন্য মূখ্যমন্ত্রী স্বামীর সরকারি গাড়িতে চড়েন নি। রিকশা করে যাতায়াত করেছেন, বাজার করেছেন। কোন নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘোরেননি। মানিক সরকারের স্ত্রী সরকারি চাকরি করতেন। মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও তিনি বাসে চলাফেরা করতেন। অন্য পাঁচজন সাধারণ নারীর মতোই সংসার সামলেছেন। এই জীবনযাত্রাই তাকে করে তুলেছে অনন্য। চলতি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যা বেমানান।
সদ্য সাবেক হওয়া এই রাজনৈতিক ব্যক্তি একেবারেই সাদাসিধে জীবনযাপন করেন। সরকারের জরিপেও তাই গরিব মুখ্যমন্ত্রীর খেতাব পেয়েছেন তিনি।
সর্বহারা এই নেতা নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় বাংলো ছেড়ে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তার বাংলো থরে থরে সাজানো অবৈধ অর্থ ছিলো না, আলমারী ভর্তি সোনা-গহনা ছিলো না। তবে ছিলো শখের বই। অগুণতি অমূল্য সেসব বই-পুস্তক তো আর দলীয় কার্যালয়ে নিয়ে ওঠা যায় না, সেখানে তেমন জায়গাও নেই। তাই বেশ কিছু বই দিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সরকারের বীরচন্দ্র স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। লেনিন রচনাবলী, দাস ক্যাপিটাল, কার্ল মার্কসসহ অনেক বই দিয়েছেন সিপিএমের দলীয় লাইব্রেরিতে। বাংলাদেশের কয়েকটি প্রকাশনার বেশ কিছু বই রেখেছেন নিজেদের কাছে। আগরতলার কৃষ্ণনগরে পাঞ্চালির বাপের বাড়ির একটি ঘরে ঠাঁই পাচ্ছে সেসব গ্রন্থ।
দলের সভাপতি হিসেবে পার্টি থেকে ব্যয় নির্বাহের জন্য দেয়া হয় কিছু টাকা। সেটা দিয়েই চলবে তার প্রতি মাসের খরচ। মানিক-পঞ্চালিদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর বাংলো ছেড়ে যাওয়াটা তো কিছুটা কষ্টেরই। এখানকার স্টাফরা কান্নাকাটি করেছে। বাংলোর গাছগুলোর কথা খুব মনে পড়বেও পঞ্চালিদের। তবু সবকিছু ছেড়ে যেতে হয়। সব মায়া, বন্ধন।
নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর দলীয় নেতাকর্মীরা যখন কান্নাকাটি করছেন তখন মৃদু হেসে মানিক সরকার বলেছিলেন, ‘কী হয়েছে? কিছুই হয়নি। ভোটে তো হারজিত আছেই।’ সেই মৃদু হাসির মাঝেও যেন কিছুটা চাপা কষ্ট ছিল। পরদিন মুখ্যমন্ত্রীর বাংলোর সামনে সবাইকে সাহস দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা তো আন্দোলনের মধ্যেই আছি। দোষ-ত্রুটি আছে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্য বা প্রতিবেশী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই গল্প হয়তো অলীক কল্পনা। কিন্তু ত্রিপুরার মানিক সরকারের পরিবার তো এমনই। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে গরিব মুখ্যমন্ত্রী থাকলেও রাজনীতিতে তিনি মানুষের মাঝে হয়ে আছেন একজন নীতিবান, আদর্শবান, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মানুষ হিসেবে।
ভাবা যায়, যে মহান ভারতে প্রতি তিন মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিত হয়। যে দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শিশু শ্রমিক, যে দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্ষুধার্ত মানুষের বসবাস, মুম্বাই, দিল্লী, আহমদাবাদে বস্তির পাশেই গড়ে উঠেছে উঁচু উঁচু অট্ট্রালিকা, বৈষম্যের অর্থণীতির সেই দেশটিতেই মানিক সরকারে মতো একজন নিরবে-নিভৃতে ন্যায়, নীতি আর সাম্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাজ্য শাসন করেছিলেন এমন এক অমূল্য ‘মানিক রতন’!
রতন আমাদের বাংলাদেশেও ছিলো। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণীর মতো সাদাসিদে মানুষ অতীতেও ছিলো, এখনও আছে। তবে সেই গ্রামীণ ছড়ার মতো বলতেই হয় –
রতনে রতন চেনে
ভোমরা চেনে মধু;
স্টীমারের সারেং চেনে
চিংড়ী মাছ আর কদু ।
ভোগবাদী এই সমাজের মানুষগুলো যেমন চোর, বাটপার, ঠগ, ধান্ধাবাজ, তারা মানিক সরকারদের মতো পরিচ্ছন্ন, নির্লোভ, মানব দরদীদের কেন ক্ষমতার কৃর্সিতে রাখবে? দাঙ্গাবাজ, খুনীদের জয়-জয়াকারে দেশ প্রেমিক মানুষগুলো ক্রমশ: ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। তবে ইতিহাসে মানিকদের ঠাঁই হলেও আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে যারা দেশের মানুষের রক্ত ও ঘামের টাকায় নিজেদের জন্য অট্রালিকা বানিয়েছে। তাদের কথা ভুলেও কেউ কোনদিন মনে করবে না।
মানিক সরকারেরা আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। অন্ধকারে আলোর শিখা। মানিক সরকারদের জন্য একবুক ভালোবাসা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন