--ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
কুয়ালালামপুর থেকে বাসে ফিরছিলাম সিংগাপুর। দোতালা বাসের উপরে উঠতেই দেখি আরো ৫ জন "ওরাং বাংলা"। একজনের আসন আমার পাশেই, বাকীরা পিছনের ছিটে। ৫/৬ ঘন্টার জার্ণি, ল্যাপটপ খুলেই একটা পেপারের কাজ শুরু করলাম। কিন্তু বিধিবাম!
শ্রমিক ভাইগুলো শুরু করলেন জোরে জোরে ফোনালাপ। স্পিকার অন করে কথা বলায় আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি উভয়ের কথা। প্রথমে আঞ্চলিক বাংলায়, তারপরে বাহাসা মালয়ে, এবং সর্বশেষ ইংরেজিতে। সবগুলোতে অসম্ভব ফ্লুয়েন্সি। ইংরেজির ধরণ এরকম: Boss, Bangladesh many many problem; father mother sick; money need...
গবেষণাকর্মে আমার মনোনিবেশ ব্যাহত হলো চরম ভাবে। তারপরও চুপ থাকলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর যখন ফোনালাপ শেষ হলো, তখন আবার কাজ শুরু করলাম। ৫ মিনিট যেতে না যেতেই বেজে উঠলো হিন্দি গান। প্রথমে ভাবছিলাম ফোনের রিংটোন। কিন্তু না, সবাই মিলেই শুনছে, আর যাত্রাপথে বিনোদিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমার পাশের জন হারিয়ে গেলেন ঘুমের রাজ্যে, আর আমাকে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন নাক ডাকার বিশাল গর্জন।
আর পারলাম না। এবার ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকালাম। এদিকওদিক তাকালাম, কিন্তু কাউকে কিছু বললাম না। দেখি, একজন স্যুট পরে আছে, কিন্তু পায়ে সেন্ডেল; অন্যজনের গলায় স্বর্ণের হার, এবং জামার উপরের বোতামটা খুলে রেখেছে যাতে হারটা সবাই দেখতে পায়; আরেক জনের মাথার উপরিভাগে খাড়া চুল রেখে দুপাশে ছুলে ফেলেছে, প্যন্টটা এমনভাবে পরেছে যে জাংগিয়ার অর্ধেকাংশ দেখা যাচ্ছে। চরম রাগে এবং ক্ষোভে একটা কথাই মনে উথলে উঠলো: এদেরকি কোন সিদেমবোধ (কাণ্ডজ্ঞান) নেই?
এবার কানে ইয়ারফোন ঢুকিয়ে শুনতে থাকলাম ওমর হিশাম আল-আরাবীর তেলাওয়াত: সুরা আল মুলক। হৃদয় বিগলিত হলো। এবার অন্যভাবে ভাবতে থাকলাম এই শ্রমিক ভাইদেরকে নিয়ে।
ভাবলাম: এরা অনেকেই দেশে অসাধু দালালদের খপ্পরে পড়ে নি:স্ব হয়েছে, জমা-জমি ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে চলে এসেছে এই সুদুর পরবাসে। এখানেও ওরা পুলিশ আর তামিল দ্বারা নির্যাতিত হয় প্রতিনিয়ত। লাথি-ঝাটা খায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে এবং ইয়ারপোর্টে। অনেকে ছিনতাইকারীর কবলে জীবনটাও হারায়। এতো কিছুর পরেও এরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বুকের রক্ত পানি করে যা উপার্জন করে তার প্রায় সবটাই দেশে পাঠায়। নিজের স্ত্রী-সন্তানের মায়া কাটিয়ে, আরাম-আয়েশকে ইস্তোফা দিয়ে এরা দেশের রিজার্ভ বাড়ায়, বাঁচিয়ে রাখে দেশের অর্থনীতিকে। দেশের দুর্নীতিবাজ নেতা আর আমলারা ব্যাংক-রিজার্ভ লুটেপুটে নি:শেষ করলেও এরা টাকা পাঠানো বন্ধ করে না, হরতাল-ভাংচুর করে না, বরং দ্রব্যমূল্য উর্ধগতির কারণে টাকা পাঠানো আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রায় সবাই এদেরকে শোষণ করে, অবজ্ঞা করে, কিন্তু এরা দেশ-বাঁচানোর মিশনে সবসময় কর্মচঞ্চল। দেশের প্রকৃত হিরো এরাই।
এভাবে ভাবতে ভাবতে একসময় বাসটি জোহরবারু পৌঁছে গেলো। নেমে পড়লো ৫ জন হিরো। দাঁড়িয়ে স্যালুট করতে ইচ্ছে হলো। দুচোখ কেমন অশ্রুতে ঝাঁপসা হয়ে গেলো। ওদের প্রতি পূর্বোক্ত ক্ষোভের বিষয়টা মনে হতেই প্রশ্ন জাগলো: আমার নিজের সিদেমবোধ আছে তো!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন