ফেসবুক ও সামাজিক মাধ্যমগুলো যেন ডুবে গেছে নানান গুজব আর ভুয়া সংবাদে। সত্য-মিথ্যার বিচার বিবেচনা না করেই আমরা নিজেরাও যেন শেয়ার ও লাইকের প্রলোভনে পড়ে এই মিথ্যার আগুনে ইন্ধন দিচ্ছি! কেউ মিথ্যা সংবাদ তৈরি করছি! কেউবা ভূয়া আইডি বানিয়ে বিদ্বেষমূলক পোষ্ট ও ভিডিও ক্লীপ ছড়াচ্ছি! কারো কারো সামনের পেছনের বক্তব্যকে কাটছাঁট করে ভয়ংকরভাবে খন্ডিত বক্তব্যকে উপস্থাপন করছি! এমনকি এগুলো প্রচারের সাথে সাথে তাকে হত্যার আহবানও জানাচ্ছি!
এইসব গুজব আর মিথ্যা খবরে আমরা এখন এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, আসন্ন নির্বাচনের আগে পড়ে এই ভয়াবহতা হয়ত আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ব্যাপক রক্তপাতের কারন হয়ে দেখা দিতে পারে। ফেসবুকসহ সামাজিকমাধ্যম এভাবে চলতে থাকলে আমরা নিজেরাই হয়ত একদিন এই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের’ হাতে মারা পড়বো।
যারা এগুলো বানাচ্ছি তারা হয়ত এটাকে রাজনীতির অংশ মনে করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের খুশিতে বগল বাজাচ্ছি। কিন্তু এই বিপর্যয় শুধু একা কোন একটা দল বা ব্যাক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা ভাবাটা চরম বোকামি।এর শিকার যে একদিন আমরা নিজেরা হবনা, তা হলফ করে বলা কঠিন।
গতবছর ২২ মে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি নিউজ ছিল “৭ মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী, ১৩ এমপির জন্য নিয়মিত মেয়ে সরবরাহ করতো নাঈম আশরাফ”। এইসব মিথ্যা ভাইরাল নিউজের বিরুদ্ধে আমি তখন সবাইকে সাবধান করে বলেছিলাম– ‘সরকারের মন্ত্রী-এমপি হোক, কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা বা দেশের সম্মানিত কোন ব্যাক্তবর্গই হোক; রক্ষা পাচ্ছেন না কেউই! এভাবে চলতে থাকলে তো একদিন হয়ত আপনিও রক্ষা পাবেন না।’
এটা সত্য যে, সরকারের একার পক্ষে এই মহামারী বন্ধ করাটা অসম্ভব। আবার এটাও সত্য যে, দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতটা নিয়ন্ত্রিত না হলে এইসব গুজব এভাবে পাখা মেলতো না।একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, যাকে নিয়ে গুজব রটাচ্ছি সে যদি কাল কেয়ামতের দিন আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করে, কি জবাব দিবো?
একটু ভাবুন, আমরা কি এইসব মিথ্যা সংবাদ যাচাই করে শেয়ার লাইক দিচ্ছি? নাকি নিজেদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এইসব মিথ্যা ও ভয়াবহ গুনাহের মধ্যে নিজেদেরকে নিক্ষিপ্ত করছি? অথচ আল্লাহর হুকুম হচ্ছে এগুলোকে যাচাই বাছাই করার।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
“মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও।” [ সুরা হুজুরাত-৬ ]
“যখন তোমরা একে মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং মুখে এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না। তোমরা একে তুচ্ছ মনে করছিলে, অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর ব্যাপার ছিল।” [ সুরা নূর-১৫ ]
আমার ফেসবুক বন্ধুদের অনেকেই মারা গেছেন। কিন্তু তাদের ফেসবুক আইডি এখনও রয়ে গেছে। একদিন হয়ত আমাদেরটাও রয়ে যাবে। অথচ আমরা থাকবো না। আমাদের এই ফেসবুক রেকর্ড আমাদের আমলনামার অংশ হয়ে আমাদের পক্ষে বিপক্ষে স্বাক্ষ্য দিবে। ভেবে দেখুন, এটা আমাদের নিজেদের হাতেই লেখা এক বিচিত্র আমলনামা!
আল্লাহ গাফুরুর রাহীম আমাকেসহ সবাইকে ক্ষমা করে দিন। মানুষের হক নষ্টের মত কঠিন গুনাহ থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। লাইক শেয়ারের চক্করে পড়ে যে ফেতনা ও অশান্তি আমরা সৃষ্টি করে চলেছি তা থেকে আমাদেরকে নিবৃত করুন।যাবতীয় প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। ‘আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে’- রাসূলের এই বানীর মর্ম যাতে আমরা অনুধাবন করতে পারি, আল্লাহর কাছে সে দোয়াই চাই।
লেখক- ড. তুহিন মালিক
টকশো ব্যক্তিত্ব ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন