রেজাউল করিম রনি
শাপলা-শাহবাগের রাজনৈতিক প্রভাব কতটা গভীরে পৌছেছে তা এখনও আমরা ঠিকমতোন ঠাওর করে উঠতে পারছি বলে মনে হয় না। এইসব বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও লেখালেখির কমতি নাই। কিন্তু যেটা হয় আর কি, আক্কেল জ্ঞান না থাকলে মহাপন্ডিতিও হস্যকর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে।
এমনিতে আমরা কৌতুকের রাজনীতির রক্তভূমিতে বেঁচে আছি। কৌতুক এখানে সাংবিধানিক বৈধতা নিয়া প্রতিনিয়ত আমাদের সাথে মশকারি করছে। বর্তমানে ক্ষমতা উৎপাদনের এক জটিল চিজ হইল এই কৌতুক। ক্ষমতাসীনদের কৌতুকের প্রতি অন্ধ পক্ষপাত এবং অন্যদিকে অক্ষম বিরোধিতার রাজনীতিই এখন কার্যকর আছে। এই অবস্থা তৈরি হইতে পারছে অশিক্ষা ও চিন্তাহীনতাকে জাতীয় ‘ঐতিহ্য’ হিসেবে আমরা মেনে নিতে পেরেছি বলেই। এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কুবুদ্ধিতার ফলে কৌতুকই এখন ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এইসব দিক মাথায় রেখে আজকের আলাপে সংক্ষেপে কয়েটি বিষয় ধরে কথা বলতে চাইতেছি–যদি পাঠক সাথে থাকেন আশা করি আলাপ আগায় নেয়া কঠিন হবে না।
শাপলার শাহবাগের পথে যাত্রা
আপনাদের আশা করি মনে আছে, শাহবাগের জমকালো উত্থানের কথা। বাংলাদেশে যারা ভারতীয় শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন তাদের পাহাড়-প্রতিম অশিক্ষা, অদম্য রোমান্টিকতা, কঠোর ইসলাম বিদ্বেষ, চুড়ান্ত মিডিয়াবাজির ওপর ভর করে বাংলাদেশে একটা রাবীন্দ্রিক বামপন্থা ও চরম সাংষ্কৃতিক ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল ২০১৩ সালে। সরকার প্রথম কয়েকদিন বামপন্থিদের গানবাজনা করার সুযোগ দিয়েছিল। ২/৩ দিন পরেই সরকার শাহবাগের পুরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। শেখ হাসিনা থাবা বাবাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ঘোষণা করেন। শাহবাগী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এর পরে শাহবাগীদের ইসলাম বিদ্বেষের খতিয়ান ফাঁস হওয়ায় এবং ধর্মনাশা এই কুচক্রকে কাউন্টার দেয়ার জন্য হেফাজত দাড়িয়েছিল। এর ফলে নাস্তিকতা ও শাহবাগ একাকার হয়ে গেল। শাহবাগী, ব্লগার আর নাস্তিক এই শব্দগুলা মিলিয়ন ডলার মূল্যের গালিতে পরিণত হল। সরকার শাহবাগকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ ক্ষমতা কনটিনিউ করার ফলে শাহবাগী তথা মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক ও নৈতিক জানাজা চূড়ান্ত হয়েছিল। এরা লীগের রাজনীতির বলির ছাগলে পরিণত হয়েছে। এদেরকেই এখন আমি বলি, শাহবাগের পরাজিত শক্তি।
বাংলাদেশে যারা ভারতীয় শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন তাদের পাহাড়-প্রতিম অশিক্ষা, অদম্য রোমান্টিকতা, কঠোর ইসলাম বিদ্বেষ, চুড়ান্ত মিডিয়াবাজির ওপর ভর করে বাংলাদেশে একটা রাবীন্দ্রিক বামপন্থা ও চরম সাংষ্কৃতিক ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল ২০১৩ সালে
৫ মে ২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি কায়দায় অ্যাটাক করার মধ্য দিয়ে শাপলা-শাহবাগ পর্বের রাজনৈতিক সহিংসতার রুপটি জনমানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ঐ বর্বর আক্রমণে ফ্যাসিবাদপন্থি, শহুরে ফূর্তিবাজ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী আনন্দে ডুগডুগি বাজাতে থাকে। তারা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে বাধ্য হয়। সরকার শাহবাগকে দখলে নিয়ে যেভাবে জনমানসপটে শাহবাগীদের ‘নাই’ করে দিয়েছিল তা এক গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করেছে প্রগতিপন্থি, চেতনাবাদি বুদ্ধিজীবীদের জন্য। এমনকি যেভাবে নাস্তিকতার বয়ানকে প্রধান দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে কিলিং শুরু হয়েছিল অনেক শাহবাগী ঠিক মতো রাতে ঘুমাতে পারত না জানের ভয়ে। এবার সরকার শাপলাকেও একই কায়দায় নিজের বগলের তলায় নিয়ে এসে সমাজে এর পটেনশিয়াল শক্তি তৈরি হওয়ার সব সম্ভাবনাকে বোতলবন্দি করে ফেলল। শাপলার করুণ পরিণতি ৫ মে’তে হয়নি। এটা হল, কওমি সনদের ছুতা ধরে শাপলার নেতাদের সরকারি দাওয়াত গ্রহণ ও আল্লামা শফী সাহেবের শেখ হাসিনাকে ধর্মপ্রাণ ও মহান ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী সহবতে শাহবাগের যেমন মতিভ্রম হয়েছিল, শাপলারও একই দশা আমরা দেখতেছি এখন। আমি মজা করে এই দোস্তির নাম দিছি, ‘তেতুল বনে বসন্ত’। ৫ তারিখে ভয়াবহ হামলার শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘শাপলা’ ঘরে ফিরে গেলেও বাংলাদেশের মানুষের মনে তাদের জন্য গভীর সমবেদনা তৈরি হয়েছিল। সমাজে তাদের অবস্থান আরও সুগভীর হতে শুরু করেছিল। কিন্তু সরকার এই সংযোগের শিকড়ে কুড়াল মেরে দিয়েছে।
এখন ‘গোস্তখোর’ লোভী হুজুর বলে কিছু পাবলিক উনাদের গালাগালি করছে। মানুষ নিজে নৈতিক না হলেও অন্যের কাছ থেকে নৈতিক আচরণ পাইতে পছন্দ করে। তবে সরকারের শাপলা বধের ধরণটা শাহবাগের মতো না। কিন্তু যেহেতু সরকার নিজেই একটা প্রকান্ড দানবীয় রুপ নিয়ে গণতন্ত্রকামী পাবলিকের মনে হাজির হয়েছে, ফলে তাদের দোস্তদের জনগণ কোনভাবেই নিরীহ ও ভালমানুষ মনে করতে পারে না। এই দুই (শাপলা ও শাহবাগ) বাইনারি শক্তির নৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে তাদের উভয়ের স্বতন্ত্র সম্ভাবনার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনাশ হল বলা যায়। যদিও বিনাশের ধরণ এক না কিন্তু আপাতত বিচারে দেখা যাচ্ছে ফলাফল একই। শাহবাগ নিয়ে প্রচুর লিখেছি। এটা এতো দিনে আমাদের কাছে বেশ পরিষ্কার। শাপলার কিছু দিক নিয়া বিস্তারিত আলাপের দরকার আছে।
কওমি–শাপলা–হেফাজত
অনেকে তর্ক করেন, কওমি-শাপলা-হেফাজত এদেরকে একাকার করে দেখা যাবে না। অবশ্যই যাবে না। এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। আবার বিরাট মিলও আছে। সব কওমি একই লেভেলে শাপলার প্রতি সহমত পোষণ করে না। আবার যারা শাপলাতে ঐক্য পোষণ করে তারা সবাই হেফাজতের সব বিষয়ে একমত হবে না– এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। তারপরেও কওমি ছাড়া শাপলা যেমন হয় না, তেমনি শাপলার কারণেই আজকের হেফাজতকে নিয়ে এতো কথা। আশা করি এটা পরিষ্কার।
কওমিদের যুক্তি হল, সনদের স্বীকৃতির সাথে হেফাজতকে জড়ানো ঠিক হবে না। এটা খুবই ফালতু লজিক হলেও এ থেকে টের পাওয়া যায় কি পরিমাণ অস্বস্তি তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। তাদের এই লজিকের পেছনে যদি কোন চিন্তাভাবনা থাকত তাইলে সনদ নিয়া মিটিংয়ে শফী সাহেব ও হেফাজতের প্রথম শ্রেণীর নেতাদের না পাঠিয়ে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে অন্য আলেমদের পাঠানো যেত। তারপরে যে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ইসলামের আওয়ামী ভার্সন চালু করার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে, সে হঠাৎ করে দুইটা হুঙ্কার দিল যে, হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে সকল মামলা তুলে নিতে হবে। আর সাথে সাথে কওমিকূল আবেগে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। যাক সেই সব কথা। সবচেয়ে মজার অবস্থা দেখা যাচ্ছে তথাকথিত হেফাজতি বুদ্ধিজীবী মহলে। শাহবাগী বুদ্ধিজীবীরা যে ফাঁপরে পড়েছিল একই পরিণতি ঘটেছে যারা শাপলাকে দিয়ে ক্ষমতা পাল্টানোর দিবাস্বপ্ন দেখেছিল– সেই সব কুমতলবওয়ালা বুদ্ধিজীবীদের কপালে। এই দিক থেকেও শাপলার শাহবাগী পরিণতি কথাটা মানানসই। এটা নিয়ে নিচে আরও আলাপ থাকছে। আগেই বলেছি, হেফাজতের অবস্থাটা শাহবাগের মতো এত সরল না। এর নানান জটিল দিক রয়েছে। আমি দুই তরফের (শাপলা/শাহবাগী) লেখালেখি দেখেছি সাম্প্রতিক সময়ে। আর হায় হায় করে উঠেছি। কি সব ব্যাখ্যা! কিভাবে সম্ভব এমন গাঁজাখোরি রাজনৈতিক বিশ্লেষকে দেশটা ভরে ফেলা? এত অশিক্ষা নিয়ে একটা দেশ কেমনে টিকে আছে? একটা উদাহরণ দেই, ‘ওয়ার অন টেরর’ –এর প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে হেফাজত নিয়া একটা কথাও চারপাশে উচ্চারণ হইতে দেখলাম না। অথচ দেশের রাজনীতি, ভোট, ফলনা-ধলনা ইত্যাদির প্রতি যে গভীর আগ্রহ ও গুরুত্ব তা কোন ভাবেই এখন বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে জাস্টিফাইড হবে না, যদি না এই ‘ওয়ার অন টেরর’ ফেনমেনন বা প্রকল্পকে আমলে নিতে না পারেন। সেই দিকটাসহ আরও কিছু বিষয় মাথায় রেখে এই লেখায় কিছু কথা বলতে হবে। তার পরেও যতটা পারি গম্ভীর তাত্বিক আলাপ এড়ায়ে সরল ভাবে সংক্ষেপে সারবো।
শাহবাগী বুদ্ধিজীবীর হেফাজতি রূপ
এখন নতুন ফ্যাশন হল, এই পরিস্থিতিকে দার্শনিক বা সমাজতাত্বিক দিক থেকে ব্যাখ্যার অক্ষমতার কারণে যারা শাহবাগের হুজুগে প্রায় জঙ্গি স্টাইলে প্রগতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির পক্ষে জেহাদি অবস্থান নিয়েছিলেন, এমন অনেক কান্ডজ্ঞানহীন বুদ্ধিজীবী এখন হেফাজতি বা ইসলামিস্ট সেজেছেন। এটাকে আমি বলি নাস্তিকের ধর্মবাসনা। অবশ্যই কিছু নাম-ধামের কাঙ্গাল ফেইসবুকার এই লিস্টে আগায়া আছে, তাদের নিয়া কথা বলার দরকার নাই। তবে আলগা পন্ডিত সলিমুল্লাহ খানের কথা বলতেই হবে। জনাব খান শাহবাগের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে তার সব শক্তি ও সৈন্য নিয়া ঝাপায়া পড়েছিলেন। হেফাজতকে বর্বর প্রমাণ করার জন্য দুনিয়ার নথিপত্র নিয়া টকশোতে কথা বলতে বলতে পাবলিকের কান ঝালাপালা করে ফেলতেন। পরে সে তার খাসিলত ও ধান্দামির লাইন মতে লীগের গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হন। এখন কওমি আলেমদের নিয়া খাঁটি রসগোল্লার মতো সুস্বাদু বয়ান ঝাড়ছেন। আর বেহুশ কওমিকূল এই আত্মপ্রতারক খানকে নিয়া লাফালাফি শুরু করে দিছে। খান লীগের অ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী লজিক সরবরাহ করছেন। এটা নিয়া মাতামাতির কিছু নাই। লজিক এমন জিনিস যা সব দিকেই ব্যবহার করা যায়। এটাকে মহাজ্ঞান মনে করার কোন মানে হয় না।
যে পাঁচ ট্রাক বই পড়ে শাহবাগকে বলে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, সে না বোঝে মুক্তিযুদ্ধ না বোঝে বাংলাদেশের সমাজ। এরা ক্লাউন, এরা নাচবে, নাচুক। আপনারা নাচ দেখেন
যাক যেটা বলতেছি, লীগের মধ্যে একটা অমিমাংসিত অসুখ শুরু থেকেই আছে। তার আত্মপরিচয়ের সংকট প্রবল। কলকাতার উপনিবেশ সূত্রে ‘বাঙালি’ হওয়ার জন্য এরা প্রায়ই মুসলিম সত্ত্বার সাথে বিবাদে জড়ায়ে পড়ে। এরা এখনও ঠিক করতে পারে নাই, লীগ কি সোভিয়েতপন্থি হাইব্রিড বামদের সাথে ঐক্য ধরে রাখার জন্য সেকুলার লাইন নিবে? নাকি মুসলিম লীগের লাইন নিবে? এটাকে আমি সহজে বলি দুই আওয়ামী লীগ। একটা হাসিনার লীগ আর একটা রাবীন্দ্রিক বামপন্ধি বা শাহরিয়ার কবির মার্কা আওয়ামী লীগ। তো এই লাইনের মধ্যে আরেক আওয়ামী প্রাণ প্রয়াত সেন্টিমেন্টাল বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার দোকানদার সলিমুল্লাহ খান ছোটবেলা থেকেই মুসলিম লীগপন্থি। ফলে এখন আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিনিধি হিসেবে সবচেয়ে ভাল সার্ভ করতে পারছেন খান। এটা নতুন সংযোজন। যখনই লীগ নেত্রী শাপলার আলেমদের সরকারি দরবারে ঠাঁই দিলেন সাথে সাথে সলিমুল্লাহ খান কওমি-দরদি হয়ে গেলেন। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসংশায় এমন সব বাকোয়াজি শুরু করে দিলেন যা কোন দিন কওমিপ্রেমী লোকজনও কয় নাই। খান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মাদ্রাসার তুলনা করে মাদ্রাসাকে উৎকৃষ্ট বলায় কওমিরা মনে হয় বুঝতে পারল, আসলেই তারা উৎকৃষ্ট! মনে হয় জাতে উঠে গেল। অথচ এই দুইটার মধ্যে তুলনা করতে পারেন কেবল একজন বেখবর মানুষ। যার কোন ধারণা নাই মাদ্রাসা নিয়া। সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হল, খানের এই কথাকে বেদবাক্য ধরে নিয়ে কওমি শিবিরে উল্লাস ও হৈ চৈ শুরু করা। খান নিয়ে বাড়তি কথার আর আপাতত দরকার নাই। অনেক আগে বলেছিলাম, যে পাঁচ ট্রাক বই পড়ে শাহবাগকে বলে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, সে না বোঝে মুক্তিযুদ্ধ না বোঝে বাংলাদেশের সমাজ। এরা ক্লাউন, এরা নাচবে। নাচুক। আপনারা নাচ দেখেন।
হেফাজতের নেতারা একটা ভুয়া কথা দেদারসে বলে যাচ্ছেন, যে হেফাজত একটি ’অরাজনৈতিক সংগঠন’। আমরা কেবল দাবি-দাওয়া ও ঈমান-আমল নিয়া “টেনশিত”। এই কথার কোন মানে হয় না। হেফাজত মোটেও অরাজনৈতিক কোন সংগঠন না। বরং হেফাজতকে কেন্দ্র করে রাজনীতির রং নানা ভাবে পাল্টাতে শুরু করেছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এটা অরাজনৈতিক তো নয়ই বরং রাজনীতির নতুন সমীকরণের জন্মদাতা হয়ে উঠেছে। তাছাড়া পাগল আর শিশু ছাড়া অরাজনৈতিক হওয়ার সুযোগ নাই -এটাও আপনারা জানেন। বরং হেফাজত বলতে পারে যে, আমরা পার্টি রাজনীতি করি না। কয়েকদিন আগে বেশ শোরগোল উঠেছিল যে, আগামী ইলেকশনে হেফাজত আসছে। এদের নাকি কিছু সিটও ভাগ করে দেয়া হবে। পরে হেফাজতের নেতারা সংবাদ মাধ্যমকে পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, হেফাজত এটা করবে না। এটা অনেক বেশি দক্ষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এরশাদের পরিণতি বরণ করার হাত থেকে রেহাই পাইল অন্তত। সরকার হেফাজতকে চায়। না চাওয়ার কোন কারণ নাই। রাজনীতি নয়, দাবি আদায় করতে চায় হেফাজত (নয়া দিগন্ত, ২৯ এপ্রিল ২০১৭)
র্যাব-পুলিশ আর মিডিয়া দিয়ে চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে না। অন্যদিকে বিরোধীদলকে দমন করতে গিয়ে মানুষের মনে বিরোধী দলের প্রতি সমর্থন নিরবে বেড়েই চলেছে। নতুন কোন শত্রু না থাকা, নতুন কোন ইস্যু তৈরি করতে না পারা, ভারতের সাথে দাস্য সম্পর্ক, অর্থ পাচারে রেকর্ড, বিদেশের নানা সংস্থার চাপ এবং লীগের ঐতিহ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি হওয়া সব মিলিয়ে সরকার ভাল অবস্থানে নাই। এদিকে নির্বাচনের আলাপও শুরু হয়ে গেছে। ফলে কোনভাবেই যদি ভোটবিহীন নির্বাচন না করা যায় তা হলে বিপদ। লীগ ক্ষমতা থেকে নেমে গেলে আগামী ৫০ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে অনেকেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। ভোটের মাঠকে ভাগ করে ফেলা দরকার। হেফাজত যদি আলাদা নির্বাচনে আসে তাহলে বিএনপি-জামায়াতের পকেটে এই ভোটগুলা আর জমা পড়বে না। তাই হেফাজতকে জাতীয় বিনোদনমঞ্চে পরিণত হওয়া সংসদে আসন দেওয়ার টোপ অফার করা। কিন্তু এটা কাজ নাও করতে পারে তাই এরশাদকে মাঠে নামিয়ে লীগপন্থি ইসলামি ঐক্যজোট করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু মুশকিল হল, লীগের সাথে এখন যারাই যাবে তাদেরকেই গ্রহণযোগ্যতা সংকটে পড়তে হবে। ফরিদ উদ্দিন মাসুদের লীগ-দরদি পজিশনের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতের মাঠে বাছুর চরতে দেখা গেছে। দেওয়ানবাগীর লীগপন্থি অবস্থান ও ভন্ডামির কারণে সে যখন অসুস্থ্য হল, পাবলিক পারলে আজরাইল পৌছানোর আগেই তারে মৃত ঘোষণা করে ফেলে। আর এরশাদের কথা কি বলব। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ জীবন্ত কৌতুক তিনি। এই হল লীগপন্থি ‘ইসলাম’ ওয়ালাদের অবস্থা। শেখ হাসিনা সেই নেত্রী যিনি মদিনা সনদ ও নাস্তিকতা দুইটাই একসাথে নিয়ে চলেন। ধর্মেও থাকেন জিরাফেও থাকেন। অবৈধভাবে ক্ষমতা নিয়ে চরম মিথ্যার ভেতর দিয়ে গদিনসীন থাকার চিকন চালাকির ফলে শুধু লীগের রাজনৈতিক কপালই পুড়ে নাই, সঙ্গীদের গায়েও ছ্যাকা লাগছে।
শুরু থেকেই বলে আসছি, হেফাজত দেওবন্দি ও কংগ্রেসি ঐতিহ্যের ভেতর দিয়া বেড়ে ওঠা সংগঠন হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে প্রো-আওয়ামী। সেই হাঙ্গামার সময়েও বলেছি, এই বিবাদ মিটলে এরা একসাথে মিলে জামায়াত-বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা যখন শাহবাগী উগ্র বুদ্ধিজীবীদের সাথে লড়াই করেছি, তখন বারবার বলেছি, হেফাজত হল একটা ‘ইসলামি সুশীল’ সংগঠন। ভয় পাবার কোন কারণ নাই। এরাও এনজিও ওয়ালাদের মতোই।তবে তাদের আন্দোলন করার অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের জঙ্গি, রাজাকার, মৌলবাদি বলা হয়েছিল তখন। এখন দেখা যাচ্ছে লীগই সবচেয়ে বড় রাজাকার! কিন্তু আমি কখনও কওমি ও শাপলাকে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য পটেনশিয়াল ফোর্স মনে করি নাই। এখনও করি না। তবে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব যে কোন সময় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম বলে মনে করি। রাজনীতিতে ’অনুভূতি’র ভূমিকা ও বিপদ নিয়ে যারা সজাগ তারা জানেন হেফাজতকে কিভাবে রিড করতে হবে। এদের হীনমন্যতা নিয়ে কথা বলার জন্য অনেকে আমার ওপর চটেছেন। ফরহাদ মজহারের মতো কিছু ব্রেইন-ডিফেক্ট লোক এদের নিয়া রং চড়ায়া কথা বলেছে। নিজে নিখিল নাস্তিক ও মূর্তিপূজারী হয়েও হেফাজতকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার গেইমে নেমে গেছিল ফরহাদ গং। এখন তার অবস্থা দেখার মতো হয়েছে। শাহরিয়ার কবিরের পরিণতি ও মজহারের পরিণতি একই হল। দুইটাই ধান্দাবাজ। লীগ দুইটারেই হাস্যকর বানায়া ছেড়ে দিল।
শিক্ষা না সনদ; ফটকা বুদ্ধিজীবীর নসিহত
শাপলাকে সরকার বেশ কয়েকটা টোপ দিয়ে বাগে আনছে, তার মধ্যে অন্যতম হল কওমি সনদ। শিক্ষা ও সনদের মধ্যে পার্থক্য আমরা কখনও তেমন গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করি না। শিক্ষা বলতে জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে বলছি, এর সাথে সনদের কোন উদ্দেশ্যগত সম্পর্ক নাই। হোক সে ব্যারিস্টারি সনদ বা কওমি সনদ। যাক এই বিষয়ে একটি লেখাকে ঘিরে কিছু কথা বলি। গত বছরের ২২ এপ্রিল বির্তকিত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার ‘ঐতিহাসিক সন্ধি’ নামে দৈনিক যুগান্তরে একটি কলাম লিখেছিলেন। এর আগেও তিনি এই বিষয়ে (কওমি মাদরাসার শিক্ষা নিয়ে) লিখেছেন। শাপলার সরকারি সখ্যতা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফরহাদের ব্যর্থতাকে পাবলিকের কাছে উদাম করে দিছে। তবে তার কাজ-কর্ম যারা অনেক দিন থেকে ফলো করেন তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন এটাই মজহারদের এজেন্ডা। কারা এই সরকারের বিরোধিতা করতে পারবে তা কিন্তু সরকার ঠিক করে দেয়। মজহার এই দায়িত্ব নিয়ে বিরোধিতার নামে সরকারের কোর্টে বল ঠেলে দেওয়ার দায়িত্বে আছেন। বিএনপি মজহারের আছর থেকে দূরে থাকার কারণে এখনও বেঁচে আছে। জামায়াত এই মজহারের জালে আটকে দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ক্রিকেটের কুফা হল পুটুনদা (আনিসুল হক) আর রাজনীতির কুফা হল ফরহাদ মজহার। সে যেই দলের দিকে ভেড়ে সেই দলের ১২টা বেজে যায়। ফলে মজহারের মতলব নিয়ে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। আজ এইসব ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা না বলে লেখাটা ধরে আলাপ শুরু করি। জানি, মজহার নিজের দোষ স্বীকার করে শুধরে নেয়ার সেই সততা দেখাবে না। তারপরেও আমার দায়িত্ব হল ওদের ব্যক্তি-কুৎসার সংষ্কৃতির বাইরে গিয়ে লেখা ধরে ক্রিটিক করা।
সে লেখার প্রথম বাক্যটাই হাকাও…
‘কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে শেখ হাসিনার ‘সন্ধি’ বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ নিমেষে বদলে দিয়েছে’।
প্রথম কথা হল, এইটা কোন ‘সন্ধি’ না। কোন সমঝোতাও না। রাজনৈতিক গেইমের অংশ হিসেবে এই ঘটনা ঘটেছে। এবং এটা হুট করে ঘটছে এমন না। এটা লীগের এজেন্ডার মধ্যেই ছিল। এর ফলে রাজনীতির কোন হিসাব-নিকাশ পাল্টায় যায় নাই।
ঐতিহাসিকভাবে হেফাজতকে বুঝবার চেষ্টা করলে ফরহাদ এটা বুঝতেন। হতে পারে তিনি নিজে হেফাজতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যেভাবে ফায়দা লুটতে চেয়েছেন সেই হিসেব ওলট-পালট হয়ে গেছে। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির কোন হেরফের হয়নি। হবেও না। যদি আমরা ধরে নেই হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের একটা ঐক্য হয়ে গেছে এবং ভোটের রাজনীতিতে সব হুজুররা নাইচ্চা-নাইচ্চা নৌকায় ভোট দিবে তা হলে অতিকল্পনা হবে। অন্যদিকে লীগ যা করে তার কোন কিছুই পাবলিক আর বিশ্বাস করে না। সব কিছুকে অবৈধ ক্ষমতার ছুতা হিসেবে দেখে। ফলে হেফাজত লীগের কোলে চড়ে বসে থাকলেও রাজনীতির কোন হিসাব নিকাশ পাল্টাবে না।
মুশকিল হল, লীগের সাথে এখন যারাই যাবে তাদেরকেই গ্রহণযোগ্যতা সংকটে পড়তে হবে। ফরিদ উদ্দিন মাসউদের লীগ-দরদি পজিশনের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতে বাছুর চরতে দেখা গেছে। দেওয়ানবাগীর লীগপন্থি অবস্থান ও ভন্ডামির কারণে সে যখন অসুস্থ্য হল, পাবলিক পারলে আজরাইল পৌছানোর আগেই তারে মৃত ঘোষণা করে ফেলে
এর পরে ফরহাদ লিখেছেন, ৫ তারিখে সরকার যাদের মেরেছে তাদেরই দাওয়াত করে রাষ্ট্রীয় ভবনে মেহমানদারি করতে হয়েছে। এটাকে সে বলছে, ‘পয়েটিক জাস্টিস’ –এটা নাকি প্রাকৃতিক বিচার। ফরহাদ নিজে আধা কবি। ফলে সব কিছুতে কাব্যিক ভাবালুতার সাথে এক ছটাক মার্কস ও কয়েক ছটাক লালন মিলায়া ব্যাখ্যার মধ্যে চিন্তাহীন আরাম হয়তো আছে, এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। এর মধ্যে নাকি একটা আধ্যাত্মিকতা আছে। পরে এই আধ্যাত্মিকতা জাস্টিফাই করতে তিনি ফকির লালনের গান কৌট করেছেন:
“তুমি ডুবাইয়া ভাসাতে পার ভাসাইয়া কিনারা দাও কারো,
রাখো মারো হাত তোমারো,
তাইতে দয়াল ডাকি আমি এলাহি আলামিন গো
বাদশা আলামপনা তুমি!!”
এই গানের আলোকে তিনি আল্লাহর কুদরত ব্যাখ্যা করেছেন। আমি জানি না বাংলাদেশের আলেমরা লালনের গান দিয়া কুদরত বোঝেন কি না? ইসলামের জ্ঞানচর্চার কি এতোই আকাল পড়লো যে বেদাতের ভেতর দিয়ে আল্লাহর কুদরত বুঝতে হবে? ফরহাদ অনেক দিন থেকেই ইসলামের নামে মনগড়া কিছু ব্যাখ্যা চালায়ে দিয়া ইসলামের মধ্যে নতুন বিভেদের রসদ সরবরাহ করতেছেন। তিনি আকবরের আদলে আরেকটা দ্বীন−ই−ফরহাদি টাইপের কিছু করতে চেষ্টা করছেন অনেক দিন থেকে। যাক সেসব কথা। এর একটু পরেই ফরহাদ চিরাচরিত পুরানা বামপন্থির মতো পুঁজির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লেগে গেলেন। বলছেন, পুঁজির দাপটের কাছে পরাজিত হয়ে হেফাজত দুনিয়াবি লাইনে দৌঁড়াইতেছে। তাইলে একটা লোক একই সাথে পুঁজির ক্ষমতা ও আল্লাহর কুদরতের লালনীয় বয়ানে কিভাবে ভরসা রাখে? এটাকে বলে তাত্বিক কেলেঙ্কারি। সবকিছু চালাকি আর রেটরিক দিয়ে করার পরিণাম এমনই হয়। তার এনজিওবাজির দক্ষতা থাকার কারণে আল্লাহর কুদরত তিনি না বুঝলেও পুঁজির কুদরত ঠিকই বুঝেন। ইসলামের নামে খালি ভন্ড পীর-ফকিররাই ধোকাবাজি করে না; এখন এটা বুদ্ধিজীবীদেরও কাজে পরিণত হয়েছে।
যারা তার চারপাশের সবাইকে ডমিনেট করে টিকে থাকে লোকে তাদেরকেই সাধারণত শক্ত নেতা বলে মেনে নেয়। এবং এই পাবলিক নিপীড়ন প্রক্রিয়ার প্রশংসা করে। এভাবেই টোটালিটারিয়ান এবং কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকে’
পরের পয়েন্টে মজহার বলেছেন, তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী, কিন্তু হাসিনার ভক্ত। হাসিনার বিচক্ষণতার তারিফ না করলে নাকি বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে তিনি অসৎ হয়ে যাবেন। উনার বুদ্ধির দৌঁড় দেখে হাসি পাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের অন্যতম কৌশল হল, মিথ অব স্ট্রং লিডারশিপ বা লৌহ নেতৃত্বের কিচ্ছা জারি করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ চোখ ধাঁধানো চমক তৈরি করে। আর ফরহাদ এটারই পূজা করতে নসিহত দিচ্ছেন। এইভাবে নিজের চিন্তার দৈন্যতার কারণে তার নিজের মনের ব্যাক্তিগত ফ্যাসিবাদি আচরণের সংগঠিত রুপ শেখ হাসিনার মধ্যে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তার ফ্যাসিবাদ বুঝটা আরেকটা ফ্যাসিবাদ তৈরি করে মাত্র। এটা নিয়ে এর আগে লিখেছি।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ আর্চি ব্রাউন তার ‘দি মিথ অফ দি স্ট্রং লিডার’ বইয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, যারা তার চারপাশের সবাইকে ডমিনেট করে টিকে থাকে লোকে তাদেরকেই সাধারণত শক্ত নেতা বলে মেনে নেয়। এবং এই পাবলিক নিপীড়ন প্রক্রিয়ার প্রশংসা করে। এভাবেই টোটালিটারিয়ান এবং কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকে। (ভিনটেজ-২০১৫)
আশা করি এবার মজহারের তাত্বিক গোলযোগ সহজেই আমাদের চোখে ধরা পড়বে। তাকে নিয়ে ডিটেইল কথা বলার মানে হয় না। প্রতিটি পয়েন্টে এমন অসংখ্যা গোজামিল চোখে পড়ে। কয়টা আর লিখব। তাছাড়া তিনি এমন কোন চিন্তক নন যে তাকে নিয়ে দার্শনিকভাবে ক্রিটিক করে দরকারি কাজ করা যাবে। তার পুরা পজিশনই রেটরিক্যাল। তারপরেও এখনকার রাজনৈতিক প্রয়োজন ও কওমি ভাইদের অতি উৎসাহের বিপদের কথা মাথায় রেখে লিখতে হচ্ছে।
‘ভারতীয় ফ্যাসিবাদের মনস্তত্ত্ব’ নামক এক প্রবন্ধে আশীষ নন্দী বলছেন, ফ্যাসিবাদি ব্যক্তি আসলে মানসিকভাবে সব সময় ভয়তাড়িত থাকেন। তার ভেতরে থাকে নিজের মতাদর্শগত দুর্বলতার ভীতি। সেই ভীতি কাটিয়ে উঠতে ফ্যাসিবাদ আদর্শকে বাদ দিয়ে হয়ে ওঠে সংগঠন সর্বস্ব। আর মজহার এই সাংঘতিক ফ্যাসিবাদের পেয়ারে আশেক হয়েছেন। এর দুর্বলতা উদাম করার বদলে নেমেছেন গুণকীর্তনে।
ফরহাদ এই লেখায় বলেছেন, ‘রাজনীতি নীতিবিদ্যা চর্চার জায়গা না’। কিন্তু তিনি যে কারণে হেফাজতের হয়ে কলমবাজি করেছেন বা সারা দিন যে বয়ান দেন তা হল, এথিকো-পলিটিক্যাল সাবজেক্টিভিটি। মানে, নৈতিক-রাজনৈতিক কর্তাসত্তার কথা বলেন সব সময়। এটা ছাড়া রাজনীতি হয় না। হেফাজতের নৈতিক শক্তিই মূলশক্তি এইসব কথা কই গেল? এখন নৈকিতার কোন দরকার নাই। পুরাটাই ফটকামি দিয়ে হাসিল করলে কোন সমস্যা নাই? আমি জানি না কওমি বা হেফাজত বা জামায়াত এই ধরণের শিশুতোষ বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে কি ধরনের নসিহত নিচ্ছেন?
কওমি সনদ নিয়ে কিছু বলা দরকার। কওমি সনদের স্বীকৃতির জিকিরটা পুরাটা বাস্তব না। এর আগে কি কওমিরা অস্বীকৃত ছিল? নাহ। তাদের স্বীকৃতির যে সিলসিলা তারা মেনটেইন করেন তাতে তারা স্বীকৃত। ফলে নতুন করে বিতর্কিত ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে স্বীকৃতি নেওয়ার প্রচারণাটা নগদ রাজনৈতিক ধান্দা থেকে করা হয়েছে এটা সবাই জানেন। আসলে তর্কটা হল, আধুনিকতার সাথে ইসলামের জ্ঞানতাত্ত্বিক ডিসিপ্লিনের। আরো পরিস্কার করে বললে, খ্রিস্টানি সিভিলাইজেশনের সাথে ইসলামের বিবাদের তর্ক এটা। কওমির যারা মনে করছেন এর ফলে দুনিয়াদারিতে তাদের সুবিধা হবে, সম্মান বাড়বে তা মোটেও বাস্তবসম্মত না। অনেক তথাকথিত মূলধারায় শিক্ষিত বেকাররা বস্তাভরা সনদ নিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যারা বলেন কওমি শিক্ষা ব্যবহার-উপযোগী দক্ষতা তৈরি করতে হেল্প করে না, তারা কি বলতে পারবেন, মূলধারা শিক্ষার মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়? এত পোলাপান রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অনার্স-মাস্টার্স করে বের হয় কিন্তু দেশের রাজনীতি বা রাষ্ট্রের কি হাল দেখেন? কি কাজে লাগছে এই শিক্ষা?
এখন চেতনার জামানায় চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা ঠিক হয় সম্পর্ক ও ঘুষ বা ছাত্রলীগ হওয়ার মধ্য দিয়ে। দক্ষতা বা সনদ কোন বিষয় না। কাজেই বাংলাদেশের মূলধারা শিক্ষা যে যুক্তিতে কওমিদের উপর তাদের এলিটিজম ফলাতে চায়, তাতে তারা তো একশভাগ ব্যর্থ। এখন পরীক্ষার আগে বিনামূল্যে ও ডিজিটাল উপায়ে প্রশ্ন পাওয়া যায়। অশিক্ষিত বামদের খপ্পরে পড়ে পাঠ্য বইয়ের যা অবস্থা তাতে প্রগতির কথা বলতে তো লজ্জা হওয়া উচিৎ। এখন এই ব্যর্থতায় নতুন শরিক হল কওমি সনদ। অন্যদিকে কওমি থেকে বের হয়ে সবাই মসজিদ-মাদ্রাসার জব করে না। এরাও নানা রকম কাজে অংশ নেয়। কিন্তু সমাজের সেকুলার ও আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিটাই এমন যে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত পড়লেই সেটা জ্ঞান। কুরআনুল কারীম বা বুখারী শরীফ পড়লে সেটা যেন কোন জ্ঞান না।
মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য যে সব বোর্ড আছে সে বিষয়ে রাষ্ট্র অবগত। এরাই তো পারেন নিজেদের সনদ বা শিক্ষার সবকিছু ঠিকঠাক করতে। সরকারি স্বীকৃতির ফলে সেকুলারাইজেশন প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেল কওমি। বা ঢুকতে বাধ্য হল। ওয়ার অন টেররের অন্যতম প্রকল্প হল একটা পশ্চিমা ধাঁচের ইসলাম চালু করা। ফলে সরকারের সাথে শাপলার ঐক্য শুধু দেশীয় রাজনীতির ভেতরের খেলাই নয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে মিলিট্যান্ট পোলাপান বেশি তৈরি হচ্ছে আধুনিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে। ফলে মাদ্রাসাকে আর হোলসেইল জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা মনে করে না পশ্চিম। কাজেই এদের বোঝানো দরকার যে এরা যেন জঙ্গিবাদী তৎপরতার দিকে না যায়, তাই আমরা ওদের শিক্ষাকে সরকারি নজরদারিতে নিয়ে আসছি, প্রগতিশীল করছি। সেকুলার মুসলিম তৈরির ঠিকাদারিতে এটা অনেক বড় কাজ।
কওমি সনদের দরকার কি? এটা দিয়ে কি হবে না হবে, সেই প্রশ্নের আগে বলতে হবে কেন এই সরকারের কাছ থেকে তারা এমন স্বীকৃতি নেয়া সঠিক মনে করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তারা অনির্বাচিত এই শাসন কালকেই ‘বাংলাদেশ সরকার’ হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। এটাকে তারা অবৈধ মনে করলে সরকারের ডাকে সুরসুর করে মিটিং করতে চলে যেতেন না। অন্যদিকে এই সরকারের আমলে শিক্ষা একটা খেলনায় পরিণত হয়েছে। এটা সবাই জানেন। কাজেই তাদের কাছে শিক্ষার মর্যাদা আশা করার মতো আহাম্মকি আর কি হতে পারে? এই সরকার যেহেতু জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসে নাই, কাজেই এদের যে কোন আদেশ পরের কোন গণতান্ত্রিক সরকার অবৈধ ঘোষণা করে বাদ দিয়া দিতে পারে। এমনকি অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে আইন করা, গ্যাজেট করা, প্রজ্ঞাপন জারি করাকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারে। এইসব কোন কিছুই আমলে না নিয়ে সনদ নিয়া শাপলা যে উচ্ছাস দেখাইল তাতে হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও রাজনৈতিক ভাবে মূর্খ সংগঠন হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করে ছেড়েছে।
এখনকার রাজনৈতিক হিসাব
শাপলার শাহবাগী পরিণতিতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে জামায়াত। হেফাজত যদি আলাদা একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে জামায়াত। জামায়াতের অর্ধ-ইসলাম, অর্ধ-আধুনিকতার লাইন থেকে প্রচুর লোক হেফাজতের দেওবন্দী লাইনে আকৃষ্ট হবে। হেফাজতের সারা দেশে কওমির মতো প্রতিষ্ঠান আছে। যা অনেক সুসংগঠিত। ফলে ইসলামি রাজনীতির যে বিশাল সুবিধা জামায়াত ভোগ করে তা আগের মতো থাকবে না। বলা যায়, সরকারের সাথে শাপলার এই কৌশলগত ঐক্য হওয়াতে জামায়াতের জন্য লাভ হয়েছে। লীগ আসলে জামায়াতকে শত্রু বানায়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে যা এর আগে রাজনীতে জামায়াতের ছিল না। জামায়াতের লীগের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বিএনপির জন্যও ভাল হয়েছে। ৫ মে’র পরে হেফাজত ও বিএনপিকে জড়িয়ে জঙ্গিবাদি কানেকশনের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ফরহাদের নামও ছিল সাথে।
তখন তিনি কিছু দিনের জন্য গা ডাকা দিয়েছিলেন। এখন লীগ আর জঙ্গিবাদি-জঙ্গিবাদি জিকির তুলতে পারবে না বিএনপি নিয়ে। কারণ হেফাজতের মতো একটা গোড়া দলের সাথে লীগ ঐক্য করার ফলে বিএনপির সেকুালার মুখ উজ্জল হয়েছে। অন্যদিকে হেফাজতের হামলার পরে বাংলাদেশে মিলিট্যান্ট ইসলাম বিস্তারের একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল পশ্চিমাদের মনে। আপনাদের অনেকরেই হয়তো মনে আছে, জাওয়াহিরি তখন একটা ভিডিও লেকচারে এই হামলার কথা উল্লেখ করে ইসলামের মিলিট্যান্ট ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন।
এশিয়াতে আমেরিকা আর নতুন করে যুদ্ধ করতে চায় না। কাজেই সরকারের এই নীতিকে হুজুরদের সেকুলার বানানোর নীতি হিসেবে সেল করা সহজ হবে। এটাও পশ্চিমা স্বার্থকে ভালভাবেই সার্ভ করে।
ইসলামের জ্ঞানচর্চার কি এতই আকাল পড়ল যে বেদাতের ভেতর দিয়ে আল্লাহর কুদরত বুঝতে হবে? ফরহাদ অনেক দিন থেকেই ইসলামের নামে মনগড়া কিছু ব্যাখ্যা চালাই দিয়া ইসলামরে মধ্যে নতুন বিভেদের রসদ সরবরাহ করতেছেন। তিনি আকবরের আদলে আরেকটা দ্বীন-ই-ফরহাদি টাইপের কিছু করতে চেষ্টা করছেন অনেক দিন থেকে
অন্যদিকে বিএনপি আন্দোলন বাদ দিয়ে বিদেশিদের সাথে দরবার ও সেলফি তোলায় বেশি মনযোগী। এখন লীগের পজিশনটা নিয়ে নালিশ করতে পারবে। পশ্চিমাদের বোঝাতে ভাল কাজে আসবে। যদিও পশ্চিমাদের সাথে এই সরকারের সম্পর্ক বোঝা যায় জঙ্গিবিরোধী তৎপরতায়। তবে পশ্চিমারা সব সময় ডাবল গেইম খেলে। এক লীগের ওপর ভরসা করবে না। বিএনপিকে হাতে রাখবে, রাখেও। সবচেয়ে বড় কথা হল যারাই এই সরকারের সাথে যাবে, তারাই ডুববে। লীগ একটা চোরাবলি। কারণ সরকার মিথ্যাকে একটা শিল্পকলা হিসেবে নিয়েছে। এই সরকারের কোন কথা পাবলিক বিশ্বাস করে না। এই সরকারের প্রতি জনগণের মনোভাব কেমন তা দুধের শিশুও মনে হয় আঁচ করতে পারে। যারাই এই সরকারের সাথে ঐক্যে গেছে তাদের পরিণতিটা বোঝাতে এরকম একটা উদাহরণ দেয়া যায় যে, লেট্রিনে দই পড়লে পুরাটাকেই আমাদের কাছে বিষ্ঠা মনে হয়।
অনুভূতি নিয়ে রাজনীতির বিপদ এবং সুবিধা দুইটাই আছে। কিন্তু এই পাবলিক অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা গেলেও কোন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের তৈরি করা যায় না দীর্ঘ সময়ের জন্য। এমনকি ক্ষমতা নিলেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। যেটা এখন ট্রাম্প ফেইস করছেন। যে দেশে পাখির মতো মানুষকে গুলি করে মারা হয় এবং পরে ক্রসফায়ার গল্প অ্যাড করা হয়, যে দেশে গুম একটি প্রতিদিনের আতঙ্ক, যে দেশে কথা বলতে হলে জীবন বাজি ধরতে হয়, সে দেশে একটি পাথরের মূর্তি নিয়ে মাতামাতি করা পরিহাসের বিষয়।
বাংলাদেশ কোন ইসলামি প্রজাতন্ত্র না। গণপ্রজাতন্ত্রও মানবেন আবার ইসলামি বিধান চাইবেন –এটা হয় না। অন্যদিকে এই দেশ কোন নট-নটির আখড়া নয় যে পাবলিক ভ্যালুজের সাথে যায় না এমন মূর্তি তৈরি করে প্রগতিশীল হতে হবে। মতাদর্শভিত্তিক পজিশন নিয়ে লড়াই করতে না পারলে অনুভূতির রাজনীতি করে বেশি দূর যাওয়া যায় না। এটা বিপদ ডেকে আনে। কোন রাজনৈতিক দলের আত্মপরিচয়ের সংকটকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া চরম হঠকারিতা। আপনারা নিজেদের মতাদর্শ ও অবস্থান পরিষ্কার করে পথে নামেন। সুরসুরির রাজনীতি কইরেন না। তাই ফাও ক্যাচলামি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্ত করতে হবে এবং পাবলিক যেন নিজেদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে তার জন্য নৈতিকভাবে শক্তিশালী রাজনীতির জমিন তৈরি করতে হবে।
কাজেই এখন লীগ-বিএনপি-জামায়াত বড় কথা নয়। দেশের গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব নিয়ে সজাগ হতে হবে। এই সরকার চলে গেলে অন্য সরকার এসে দেশে স্বর্গ নামিয়ে আনতে পারবে না। আমাদের দরকার রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার উপযোগী রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা। বাংলাদেশের নাগরিকদের মর্যাদার কোন হানি হবে না এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই এই সময়ের কাজ।
জবান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন