কাশিমপুর জেল থেকে ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর মুক্তি পাওয়া থেকে অদ্যাবধি আমার প্রতিটি বক্তব্য এবং লেখায় বাংলাদেশের দখলদার শাসক শ্রেনির ফ্যাসিবাদী চরিত্র জাতির কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই ফ্যাসিবাদের পেছনের মূল শক্তি যে আধিপত্যবাদী ভারত সেই কথাটিও বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। দেশে গণতন্ত্রের জন্যে লড়াইরত জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে যে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছি তার মোদ্দা কথাগুলো আমার মুক্তিসংগ্রাম বিষয়ক নিবন্ধের শেষ কিস্তিতে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
(১) ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করেছে। নির্বাহী বিভাগ,আইনসভা এবং বিচার বিভাগ এক অভিন্ন ব্যক্তির ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে।
(২) এই ফ্যাসিবাদের প্রাণভোমরা ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী দ্বারা সংরক্ষিত।
(৩) বিশ্বের ইতিহাসে কখনো এবং কোথাও শান্তিপূর্ন ভোটের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেনি। গণঅভ্যুত্থান এবং বিপ্লবই ফ্যাসিবাদের নিগড়ে আবদ্ধ জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ।
(৪) ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে কোন সময়সীমার মধ্যে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এই লড়াই একটি চলমান প্রক্রিয়া। আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই প্রক্রিয়ায় সমাজের সর্বস্তরের বেসামরিক এবং সামরিক জনগোষ্ঠী একত্রিত হলে তবেই ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে এবং আধিপত্যবাদকে প্রতিহত করা যায়।
(৫) ফ্যাসিবাদবিরোধী লাড়াই এর জন্য দৃঢ়, সাহসী এবং আপোসহীন নেতৃত্ব অপরিহার্য।
জেল থেকে বের হয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম যে, জাতীয়তাবাদী শিবিরে আন্দোলনের পরিবর্তে সময়ের অনেক আগেই এক ধরনের নির্বাচনী আবহ বিরাজ করছে। তত্বাবধায়ক সরকার পুন: প্রতিষ্ঠার যৌক্তিক দাবী থেকে সরে গিয়ে বিভ্রান্ত নেতৃবৃন্দ এক বায়বীয় সহায়ক সরকারের কল্পকাহিনী সামনে এনে নিজেদের দূর্বলতাই প্রকট করে তুলেছেন। হয়ত নেতৃবৃন্দ এটুকু বুঝতেও সক্ষম হননি যে, গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করে তারাই অবৈধ, দখলদার প্রধানমন্ত্রীর বিচার বিভাগীয় এবং সাংবিধানিক ক্যু’কে বৈধতা দিচ্ছেন। সাবেক চরম অনৈতিক এবং দলবাজ প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে দিয়ে শেখ হাসিনা প্রথমে তত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে কোন গণভোট ছাড়াই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র হত্যা করেছেন। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ এবং দলটির বশংবদ কথিত বুদ্ধিজীবীরা এক সুরে বলে চলেছেন যে, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্ন তুলতে পারতেন যে ১৯৯০ সালে কোন্ সংবিধানের বলে তৎকালিন প্রধান বিচারপতি তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছিলেন? কিংবা ১৯৯৪-৯৫ সালে সংবিধানের কোন্ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জামাতে ইসলাম এবং বিশ্ব বেহায়া স্বৈরাচার এরশাদকে সাথে নিয়ে শেখ হাসিনা তত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংস ও সন্ত্রাসী আন্দোলন করেছিলেন?
১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া প্রথমবারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯০ সালের সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা হস্তান্তরকে বৈধতা দিয়েছিলেন। এবং তিনিই ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কালীন দলনিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। বেগম জিয়া ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানকে মহিমান্বিত এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করবার মহৎ উদ্দেশেই সংবিধানে একাদশ এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী এনেছিলেন। দূর্ভাগ্যবশত: তত্বাবধায়কের জায়গায় ‘সহায়ক’ আমদানি করে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার মহৎ অবদানকে খাটো করবার পাশাপাশি আপোষ কামিতার চোরাবালিতে সদলবলে পা দিয়েছেন। এই ভুলের সুযোগ নিয়েই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এখন বলতে পারছেন যে, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির নেতাদেরই অবস্থানের ঠিক নেই। তারা একবার বলে তত্বাবধায়ক, কখনো বলে সহায়ক আবার কখনো বা দল নিরপেক্ষ। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নিয়ে আগাম অতি উৎসাহের মধ্যে আমি আন্দোলন বিরোধী মনোভাবের বহি:প্রকাশ দেখতে পেয়ে শংকিত হয়েছিলাম। পরাজিত অথবা দূর্বল মানসিকতা নিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদের দোসর বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয়লাভ করা দূরুহ। আমি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সাথে অনেক বিতর্ক করেও সহায়কের ভুত তাদের মাথা থেকে নামাতে পারিনি।
দখলদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ দালাল রকিব কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে গত বছর চিহিৃত আওয়ামী পন্থীদের সমন্বয়ে আর একটি নতজানু নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পরও বিএনপি কোনরুপ কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার বিরোধী ‘জনতার মঞ্চের’ একজন সংগঠক ছিলেন। চার দলীয় জোট সরকার আমলে যুগ্ম সচিব পদে থাকা অবস্থাতে তাকে অবসরে পাঠানো হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাকে অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে এক ধাপে ডবল প্রমোশন দিয়ে সচিব বানিয়ে পুনরায় অবসরে পাঠান। ক্ষমতাসীনদের অত্যন্ত বিশ্বস্থতারই এই প্রকার পুরস্কার পেয়েছেন। শেখ হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে অপরিসীম কৃতজ্ঞ এবং আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এক ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানানো হলেও বিএনপি কেন তাকে প্রায় নীরবে মেনে নিল সেটা শত কোটি টাকার প্রশ্ন। এবং সেই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তবে বিএনপির মাঝ পর্যায়ের দুই-একজন নেতা আমাকে বলেছেন যে, নির্বাচনের সময় নাকি এই ব্যক্তি নিরপেক্ষ থাকবেন। আশাবাদ ভাল, তবে বেআক্কেলে আশাবাদ আত্মঘাতী। নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ন তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। রকিব কমিশন এবং নুরুল হুদা কমিশন গঠনের আগে ক্ষমতাসীন সরকার সার্চ কমিটি গঠন করেছিল। উভয় সার্চ কমিটির প্রধানের পদ একই ব্যক্তি অলংকৃত করেছেন। সেই ব্যক্তি বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ওয়াহাব মিঞাকে ডিঙিয়ে সরকার সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি বানিয়েছে। বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হতে পারেননি। অতএব বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অনেক সার্চ করে যাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়েছেন তিনি যে অবশ্যই শেখ হাসিনারও আস্থাভাজন হবেন তা নিয়ে আকাট মূর্খ এবং আগাপাছতলা নির্বোধ ছাড়া আর কারো মনে সন্দেহ থাকার কথা নয়। গাজীপুরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হাইকোর্টে স্থগিত হওয়ার ঠিক পরের দিন আমি লিখতে বসেছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় এরপরও যদি বিএনপির রাজনৈতিকভাবে অতি ‘প্রাজ্ঞ’ নেতৃবৃন্দ সন্তÍষ্ট থাকেন তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। এই দলটির কিছু নেতৃবৃন্দের মধ্যে দলীয় প্রধানকে কারাগারে রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বাসনার প্রকাশও মাঝে- মধ্যে দেখতে পাই। মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে হেদায়েত করুন।
গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে তামাশা বাংলাদেশের অকার্যকর বিচার বিভাগ এবং নতজানু নির্বাচন কমিশনের প্রকৃত চেহারা পুনরায় উম্মোচিত করেছে। এখান থেকেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সূচনা হওয়া সম্ভব। তবে তার আগে দিল্লির আধিপত্যবাদের বিষয়ে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী দলসমূহের অবস্থান জনগনের কাছে পরিস্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী এবং চরম মুসলমান বিদ্বেষী নরেন্দ্র মোদি দিল্লির তখতে আসীন হলে উল্লেখিত নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারনা জন্মায় যে, যেহেতু আওয়ামী লীগের সংঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রাচীন ও সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে তাই দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলে সেখানকার বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আসবে। বিরোধীদলের অতি উৎসাহী ব্যক্তিরা দিল্লিতে যাওয়া-আসাও বাড়িয়ে দেন। বিজেপি নেতৃত্বের কোন পর্যায় পর্যন্ত এরা শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পেরেছেন সেটা নিয়ে ঢাকার রাজনৈতিক মহলে অনেক কৌতুককর গল্প প্রচলিত আছে। আমি সেই প্রসঙ্গে একেবারেই যাচ্ছি না। আমার আজকের আলোচনা কেবল ভূ-রাজনীতি এবং আন্তজাতিক সম্পর্ক বিষয়ক।
ভারতীয় শাসকশ্রেণি বাংলাদেশকে নিজেস্ব বলয়ের একটি আশ্রিত রাজ্য রূপেই বিবেচনা করে থাকে। তারা এটাও জানে যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৃষ্ট বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনই ভারতের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের পথের মূল বাধা। এ দেশের ইতিহাসের জনপ্রিয়তম রাষ্ট্র প্রধানের হত্যার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়েও বাংলাদেশে এবং ভারতে যথেষ্ট আলোচনা রয়েছে। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগের সংঙ্গে সেই একই গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগ সেই পাকিস্তানী আমল থেকেই স্থাপিত। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ভারতের অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থরক্ষায় আওয়ামী লীগ বিশ^স্ততার সাথে প্রভুর যাবতীয় হুকুম পালন করেছে। দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশ নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। কেবল মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে দাদাসুলভ দাম্ভিকতা পরিহার করে সৎ প্রতিবেশীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকে নির্বাচনে হারিয়ে ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হলে ভারত তার পূর্বের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতিতে ফেরত গিয়েছিল।
১/১১ পরবর্তী বিশে^ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে দিল্লি দক্ষিন এশিয়ায় তার আঞ্চলিক সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে ভারত এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত এবং সামরিক মিত্র। ভারত আঞ্চলিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষে সর্বত্র পরাজিত হলেও ৯০ শতাংশ মুসলমানদের বাসভুমি বাংলাদেশে দূর্ভাগ্যজনকভাবে জয়ী হয়েছে। দেশটির দালালগোষ্ঠী এদেশে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তদুপরি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দোদুল্যমানতা, ইসলামী দলসমূহের ঈমানী শক্তির ঘাটতি এবং সেনাবাহিনীর অতি মাত্রায় বানিজ্যকরণের বিষময় ফলে আমরা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছি। বাংলাদেশে গনতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং মানবাধিকার অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা যে ভারত এই কথাটি প্রকাশ্যে বলার মত নাগরিক খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরঞ্চ, কংগ্রেস এবং বিজেপি নির্বিশেষে শাসকশ্রেনির আনুকূল্য পাওয়ার নগ্ন ও লজ্জাস্কর প্রচেষ্টা সর্বত্র দৃশ্যমান। ২০০৮ সালে তৎকালিন সেনা প্রধান মইন ইউ আহমেদ চাকরী রক্ষার জন্যে প্রণব মুখার্জীর কাছে তারই বর্ননা অনুসারে যে ভাবে এবং ভাষায় দেন-দরবার করেছিলেন তাতে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের সকলের মাথাই হেট হয়েছে। সেদিন আমাদের সেনাবাহিনীও সম্ভবত: তাদের জাতীয়তাবাদী চরিত্রও বিসর্জন দিয়েছে। দখলদার সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সাম্প্রতিক সদলবলে দিল্লি সফরের পর বিএনপির কোন কোন নেতা যেভাবে সেই তীর্থে যাওয়ার জন্যে আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন তাতেও আমাদের সম্মান বৃদ্ধি হয়নি। দিন দুয়েক আগে ভারতীয় পত্রিকার বরাতে ফেসবুকে দেখলাম যে ভারতপন্থী সংবাদমাধ্যমের রথী-মহারথীরা দিল্লির প্রভুদের দরবারে হাজির হয়েছেন। ভারত সম্পর্কে এই দাসসুলভ মানসিকতা পরিহার না করতে পারলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম সোপানই অতিক্রম করা যাবে না।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র নির্বিশেষে এ দেশের তরুনরা পিন্ডির ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্খায় তারা অকাতরে প্রান বিসর্জন দিয়েছে। দখলদার সেনাবাহিনীর মেশিন গান, কামান, ট্যাংক, ইত্যাদি কোন কিছুই তাদের চুড়ান্ত বিজয়কে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। আমাদের স্মরনে রাখতে হবে যে দেশপ্রেম এবং আপন ধর্মের প্রতি আবেগই মানুষকে চুড়ান্ত আত্মত্যাগে অনুপ্রানিত করে। দৃশ্যত: আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নীতিনির্ধারকবৃন্দ এই চরম সত্যটি হয় উপলব্ধি করতে পারছেন না অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে হরণ হয়ে গেছে সেই কথাটি দ্বিধাহীনভাবে দেশপ্রেমিক জনতাকে জানিয়ে আজ তাদেরকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যোগদানের আহবান জানাতে হবে। সেই সঙ্গে এটাও বলতে হবে যে, কথিত ইসলামী জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার নামে ভারতের পদলেহী শাসকশ্রেণি এ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মকেই প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। বাঙ্গালী মুসলমানের নিজস্ব গৌরবজ্জ্বল সংস্কৃতি ধ্বংস করার অপচেষ্টায় ইসলামবিদ্বেষী সরকার যাবতীয় পৌত্তলিকতানির্ভর অপসংস্কৃতিকে মদদ দিচ্ছে। এ দেশের বর্তমান শাসকশ্রেণি এবং তাদের দিল্লির প্রভুরা এটা ভালই বোঝেন যে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বিজয়ী হওয়া সম্ভব হলে একটি জাতিকে পদানত করতে আর সামরিক আগ্রাসনের মত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ন বিকল্পের প্রয়োজন হয়না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে যাতে কোন বাধা সৃষ্টি না হয় এই উদ্দেশেই বাংলাদেশে ভিন্নমতের মিডিয়া একে একে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জনগনকে অন্ধকারে রাখার জন্যে সকল ফ্যাসিবাদী শাসকই গণমাধ্যমের ওপর এ জাতীয় নিয়ন্ত্রন আরোপ করে থাকে। এ দেশে সভা-সমাবেশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জনগনের ভোট প্রদানের অধিকার হরণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আজ দিল্লির দখলে এবং জনগণ ফ্যাসিবাদের কারাগারে।
এমতাবস্থায়, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মৌলিক ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া মুক্তিসংগ্রামের পূর্বশর্ত। সেই মৌলিক ইস্যুগুলো নির্ধারণ করতেই আমি জনগনের উদ্দেশ্যে কতগুলো প্রশ্ন এখানে উত্থাপন করছি।
(১) আমরা কী দিল্লির নিয়ন্ত্রনমুক্ত পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই?
(২) বাংলাদেশের জনগণ কী নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক?
(৩) এ দেশে কী চিন্তা, বিবেক এবং গণমাধ্যমের পূর্ন স্বাধীনতা থাকবে?
(৪) আমরা কী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে এমন একটি প্রকৃত স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই যেখানে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছ নীতিমালা থাকবে এবং বিচারপতিরা নির্ভয়ে ন্যায়বিচার করতে পারবেন?
(৫) আমরা কী চরম অত্যাচারী বর্তমান পুলিশী রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন করে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই?
(৬) আমরা কী চলমান দুর্নীতি পরায়ন শাসনের অবসান ঘটিয়ে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র কায়েমে একমত?
(৭) আমরা কী গণতান্ত্রিক ও কল্যানমুখী বাংলাদেশ গড়তে চাই?
(৮) আমরা কী বাঙালী মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও গৌরবজ্জ্বল সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে বিশ্বাসী?
উপরোক্ত প্রশ্ন সমূহের জবাবের ভিত্তিতে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ একটি সার্বজনিন নীতিমালা (ঈড়সসড়হ অমবহফধ) গ্রহণ করলে আমার বিশ্বাস আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বিপুলভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। সঠিক রাজনৈতিক বার্তা প্রণয়নের পর গণআন্দোলনের জন্যে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ন উপাদান হলো উপযুক্ত নেতৃত্ব এবং বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচি।
১৯৭৫ সালে নবীন বাংলাদেশের এক নাজুক ও চরম বিপদজনক সময়ে জেনারেল জিয়া দৃঢ় হাতে রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন। তিনিই ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে দিশাহারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের দিকে তাদের পরিচালিত করেছিলেন। যে ব্যক্তি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন, তিনিই আবার পরবর্তীতে ভারতের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে সাহসের সাথে মোকাবেলা করেছিলেন। আগ্রাসী শক্তি যেই হোক না কেন, তাকে প্রতিরোধ করা যে সকল দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব, শহীদ জিয়া সেটাই বারে বারে প্রমান করেছেন। তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দেশের সকল স্বাধীনতাকামী, জাতীয়তাবাদী, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।
আজ তার আদর্শের সেই পতাকা বেগম খালেদা জিয়ার হাতে। তিনি সম্পূর্ন বানোয়াট মামলায় ফ্যাসিবাদের কারাগারে অন্তরীন। যখন আমি লেখার প্রায় শেষ পর্যায়ে ঠিক তখনই সুপ্রিম কোর্টে বেগম জিয়ার জামিনের শুনানী চলছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থার অধীনে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলায় জামিন পাবেন কিনা আমার জানা নেই। তবে জামিন পেলেও সহসা যে মুক্তি পাচ্ছেন না এ বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। আরো অনেকগুলো ভুয়া মামলায় তাকে শ্যোন এরেষ্ট দেখিয়ে রাখা হয়েছে। সে গুলোতে জামিন পেতে যে সময় ক্ষেপন করা হবে তার মধ্যেই তাকে দুদকের অপর বানোয়াট মামলায় উপরের নির্দেশে সাজা দেয়ার প্রবল সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং কারান্তরীণ বেগম জিয়াকে বিপ্লবের প্রতীক ধরে নিয়েই আমাদের গণআন্দোলনের প্রস্তÍতি নিতে হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু এ কারনে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনা এবং বাংলাদেশের আপামর জনগণের স্বসস্ত্র সংগ্রাম আটকে থাকেনি। সেই জিয়ার হাতে গড়া দলের নেতাকর্মীরা তাদের নেত্রীকে কারাগারে রেখে লড়াইয়ের ময়দান থেকে পিছুটান দিতে পারেনা। অতএব বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাছে আমার রাজপথে নামার আহবান থাকবে। গুটি- কয়েক পুলিশ দেখলেই পলায়নের মনোবৃত্তি ত্যাগ করতে হবে। ফ্যাসিবাদের কাছ থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করা যায় না। ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেই মুক্তি অর্জন করতে হয়। আমি আরো মনে করি আন্দোলনের চরিত্র বর্ননায় শান্তিপূর্ন অথবা কঠোর ইত্যাদি বিশেষণের কোন প্রয়োজন পরে না। সময় এবং পরিস্থিতি আন্দোলনের চরিত্র নির্ধারন করে। বিশ্বের ইতিহাসে দেখা গেছে যে সর্বদা ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীই জনগনের আন্দোলনকে সহিংসতা দিয়ে দমন করতে চায়। এদেশেও অবৈধ ফ্যাসিবাদী সরকার সহিংসতা অবলম্বন করেই টিকে আছে। হয়তো একদিন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে তাদের সবার বিচার হবে। বাংলাদেশের তরুন সমাজের প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনেও তাদের আপোসহীন, লড়াকু চরিত্রের পরিচয় মিলেছে। আমি দঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে জেল-জুলুমের পরোয়া না করে বিএনপির নেতৃবৃন্দ রাজপথে লড়াইয়ের অগ্রভাগে অবস্থান নিলে যে গণ-জোয়ারের সৃষ্টি হবে তাতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন তাবেদার ও দখলদার অপশক্তি ফেরাউনের মতোই নিমজ্জিত হবে। জিয়ার আদর্শের অনুসারীদের কাছ থেকে প্রকৃত সেনাপতির আচরনই জনগন প্রত্যাশা করে। একজন পেশাজীবী হিসেবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের মুক্তি সংগ্রামে জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সকল পেশাজীবী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথেই অবস্থান নেবে। অতএব, আর বিলম্ব নয়। বিপ্লবের এখনই প্রকৃষ্ট সময়।
আরবিএন২৪
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন