সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশীয় টেলিভিশন সিরিয়ালসমূহের মধ্যে তুর্কি টিভি সিরিয়ালসমূহ বর্তমানে বিশেষ এক স্থান দখল করে নিয়েছে। কাহিনী, নির্মাণশৈলী, অভিনয়, ফ্যাশন প্রভৃতি দিক থেকেই বিশ্বব্যাপী দর্শক হৃদয় জয় করে নিয়েছে এই সিরিয়ালগুলো। হলিউডের ‘গেম অব থ্রনস’ বা ‘ভাইকিংস’ এর পাশাপাশি তুরস্কে নির্মিত ‘দিরিলিশ এরতুরুল’ বা ‘পাইতাহত আবদুল হামিদ’ সিরিয়ালগুলো সমানতালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শকরা উপভোগ করছে। অনেকক্ষেত্রে হলিউডে নির্মিত টিভি সিরিয়ালগুলো থেকে অধিক সাড়া পাচ্ছে তুর্কি এই টিভি সিরিয়ালগুলো। অশালীন বা সহিংস দৃশ্য পরিহারের কারণে সর্বস্তরের দর্শকদের কাছে এই সিরিয়ালগুলো সমাদৃত হচ্ছে।
তুর্কি সিরিয়াল ‘দিরিলিশ: এরতুরুল’ (Diriliş: Ertuğrul)' বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এমনই একটি সিরিয়াল। তুরস্কে জনপ্রিয়তা লাভের পর বিশ্বের বিশটিরও বেশী দেশে এটি প্রদর্শিত হয়েছে। ইংরেজি, রুশ, আরবী, ফারসী, উর্দু, বাংলা, মালয় সহ বিভিন্ন ভাষায় এটি অনুদিত হয়ে সাব-টাইটেল বা ডাবিং এর মাধ্যমে এটি প্রদর্শিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মাছরাঙ্গা টিভিতে রবি থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন রাত আটটায় এটি বাংলায় ডাবিং হয়ে প্রচারিত হচ্ছে।
মূলত তুরস্কের টিভি চ্যানেল টিআরটি ওয়ানে প্রচারিত হয়ে আসা ‘দিরিলিশ এরতুরুল’ সিরিয়ালটির প্রথম পর্ব প্রচারিত হয় ২০১৪ সালের ১০ই ডিসেম্বর। মূল তুর্কিতে প্রায় আড়াই ঘন্টার এক একটি পর্বের টিভি সিরিয়ালটির এখন পর্যন্ত চারটি সিজনে মোট ১১৫ টির মত পর্ব প্রচারিত হয়েছে।
মধ্য এশিয়া থেকে আনাতোলিয়ায় এসে বসতি স্থাপনকারী তুর্কি যাযাবর গোষ্ঠী কায়ী গোত্রের সর্দার সুলাইমান শাহের ছেলে এরতুরুল গাজীকে কেন্দ্র করে সিরিয়ালটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। মঙ্গল আক্রমণের কারণে নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া কায়ী গোত্রকে নতুন আবাসস্থলেও টিকে থাকার জন্য মোকাবেলা করতে হয় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সাথে। ক্রুসেডার, মঙ্গল, বাইজান্টাইনদের শত্রুতার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যকার বিশ্বাসঘাতক ও ক্ষমতালোভীদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাদের। নিজের সঙ্গী-সাথী ও গোষ্ঠীর লোকজনের সাহায্যে একে একে সকলের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এরতুরুল নিজের গোষ্ঠীকে নিরাপদ করেছেন সকল প্রকার বিপদ-আপদ ও হুমকি থেকে। অসংখ্যবার মৃত্যুর ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার পরও নিজেকে সকল প্রকার বিপদ থেকে মুক্ত করে তিনি নিজেকে এবং নিজের গোত্রকে নিয়ে গেছেন অধিকতর মর্যাদার স্থানে। পিতার মৃত্যুর পর গোষ্ঠীর সর্দার হয়ে তিনি প্রতিনিয়তই লড়ে গেছেন নিজ গোত্র ও মুসলিম রাজ্যসমূহকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। পরবর্তীতে সেলজুক সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদ কর্তৃক বাইজান্টাইন সীমান্তবর্তী প্রদেশের গর্ভনর হিসেবে নিযুক্ত হয়ে তিনি নিজের গোত্রের জন্য একটি স্থায়ী আবাসের অধিকার লাভ করতে সক্ষম হন। বাইজান্টাইন সীমান্তের গর্ভনর হিসেবে এরতুরুল গাজীকে লড়াই করতে হয় বৈরীভাবাপন্ন প্রতিবেশীর সাথে। এই লড়াই করতে গিয়েই তিনি কায়ী গোত্রের নিজস্ব রাজ্যের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এরতুরুল গাজীর ছেলে ওসমান গাজীর হাতে কায়ী গোত্র হতে উদ্ভূত তিন মহাদেশ শাসনকারী বিশাল ওসমানী সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। পরবর্তী ছয়শত বছর এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ ব্যাপী বিস্তৃত এই ওসমানী সাম্রাজ্যই সারাবিশ্বে মুসলিম সভ্যতা ও শৌর্যের প্রতিনিধিত্বকারী সাম্রাজ্য হিসেবে ভূমিকা পালন করে এসেছে। সুতরাং, ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা এরতুরুল গাজীকে চিহ্নিত করতে পারি।
নিজের গোত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং ওসমানী সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের স্বার্থে এরতুরুল গাজীকে বিভিন্ন বিপদ ও প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সকল বিপদ ও প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করে তিনি নতুন করে উচ্চতর অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। সিরিয়ালটির নাম ‘দিরিলিশ’ (Diriliş) হওয়ার স্বার্থকতা মূলত এখানেই নিহিত রয়েছে। প্রতিটি বিপদের পরে নতুন করে ‘পুনরুত্থানে’র (দিরিলিশ) ধারণার সাথে সাদৃশ্য রেখেই সিরিয়ালটির নাম রাখা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই সিরিয়ালটি বর্তমানে ইংরেজি সাবটাইটেলে নেটফেক্সে পাওয়া যাচ্ছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক পটভূমিতে নির্মিত এই সিরিয়ালটির নির্মাণশৈলী যে কারোরই মন ছুঁয়ে যাবে। একজন সাধারণ মুসলিমের দৈনন্দিন আচার, শৌর্য-সাহসিকতা, ইসলামের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান সর্বোপরি অশালীনতামুক্ত এই সিরিয়ালটি মুসলিম দর্শককে আরো বেশী আকর্ষণ করবে। সুতরাং, সুযোগ পেলে আজই শুরু করুন আপনার ‘দিরিলিশ এরতুরুল’ দর্শনের যাত্রা...
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন