মোস্তফা ফয়সল পারভেজ
আগামী ২৪ জুন তুরষ্কে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট পদে ৫ জন প্রার্থী (বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, সিএইচপির মোহাররেম ইনজে, ইয়ি বা গুড পার্টির মেরাল আকসেনার, কুর্দিশদের এইচডিপির সালাদিন দেমিরতাশ এবং সাদাত পার্টির তেমেল কারামুল্লাউলু) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। অপরদিকে সংসদ নির্বাচনে দুইটি শক্তিশালী রাজনৈতিক জোট এবং আরো কিছু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে। এরদোয়ানের একেপির নেতৃত্বে "জুমহুর ইত্তিফাক" নামক জোটে একে পার্টি, জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি এবং ইসলামিক জাতীয়তাবাদী দল বুয়ুক বির্লিক পার্টি। অপরদিকে আতার্তুকের অনুসারীদের সিএইচপির নেতৃত্বে "মিল্লেত ইত্তিফাক" নামক জোটে সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী দল থেকে ভেংগে নব গঠিত ইয়ি পার্টি বা গুড পার্টি, তুরষ্কের ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি। কুর্দিশ রাজনৈতিল দল এইচডিপি কোনো জোটে না গেলেও গত ১১ তারিখে কুর্দিশ শহর দিয়ারবাকারে সিএইচপির সমাবেশে দলীয় পতাকাসহ এইচডিপির অনুসারীদের অংশগ্রহন এবং তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দেমিরতাসের সাথে সিএইচপি প্রার্থী মোহাররেম ইনজের সাক্ষাতের মাধ্যমে সিএইচপি জোটের সাথে তাদের গোপন কোয়ালিশনের বিষয়টা প্রকাশ্যেই এখন মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে টানা ১৬ বছর যাবত ক্ষমতায় থাকা একে পার্টি প্রথমবারের মত শক্তিশালী চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
কেনো এই নির্বাচন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং:
তুরষ্কের রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত ব্যক্তি হিসেবে এরদোয়ান এবং দল হিসেবে একেপি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ের জন্য এরদোয়ানকে ৫০% এর অপর ভোট পেতে হবে। প্রথম রাউন্ডে যদি বিজয়ী হয় তাহলে সহজেই এই যাত্রায় বেচে যাবে কিন্তু নির্বাচন দ্বিতীয় রাউন্ডে গড়াইলে এরদোয়ানকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। কারন সেক্ষেত্রে সিএইচপির নেতৃত্বে সাদাত, ইয়ি পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির জোট ছাড়াও কুর্দিশ জাতীয়তাবাদী দল এইচডিপিও এই জোটে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সাধারন তার্কিশদের মতে প্রেসিডেন্ট পদে এরদোয়ান প্রথম রাউন্ডেই জিতে যাবে। বেশিরভাগ জরিপে প্রেসিডেন্ট পদে এরদোয়ান ৫০-৫৪%, সিএইচপির মোহররেম ইনজে ২০-২২%, ইয়ি পার্টির মেরাল আকসেনার ৮-১২%, সাদাত পার্টির তেমেল কারামুল্লাউলু ১-৩% এবং কুর্দিশ এইচডিপি ৯-১১% ভোট পেতে পারে। কিন্তু একই সাথে এরদোয়ানের দল একে পার্টিকেও ৩০০+ আসনে বিজয়ী হতে হবে। বিভিন্ন জরিপে দল হিসেবে একেপি ৪২-৪৬%, জাতীয়তাবাদি এমএইচপি ৭-৯%, ইসলামিক জাতীয়তাবাদী বুয়ুক বির্লিক ১-২%। অপরদিকে বিরোধী জোটের সিএইচপি ২৪-২৬%, ইয়ি পার্টি ৫-৭%,
কুর্দিশ জাতীয়তাবাদী এইচডিপি ৮-১০%, সাদাত পার্টি ১-৩% ভোট পেতে পারে। সাদাত পার্টির সমর্থকদের মতে ৫-৭% ভোট পাবার সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে ১-৩% এর বেশি সম্ভাবনা নাই। কারন নাজমুদ্দিন আরবাকানের মিল্লিগুরুশের ৯০% ভোট এখন পর্যন্ত একে পার্টি পায়, যদিও এরবাকান হোজা বিভিন্ন নির্বাচনে ৮-২১.৬% পর্যন্ত ভোট পেয়েছিলেন। তবে কোনো কারনে কুর্দিশ এইচডিপির ভোট যদি ১০% এর সামান্য নীচে চলে আসে তাহলে সমগ্র কুর্দিশ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে এরদোয়ানের একেপি ৯০% আসন পেয়ে যাবে। শান্তিপ্রিয় এবং ধার্মিক কুর্দিশদের ভোট বরাবরই এরদোয়ান এবং তার দল পেয়ে আসছে। এইচডিপি কুর্দিশ সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পিকেকের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে অঘোষিতভাবে পরিচিত থাকা এবং বাম আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় ধার্মিক এবং শান্তিপ্রিয় কুর্দিশরা বরাবরই তাদের এড়িয়ে চলেছে।
তবে বিরোধী জোটের কিছু কাজ যেগুলোর কারনে আল্টিমেটলি এরদোয়ান এবং একেপি লাভবান হচ্ছে।
সিএইচপির অভ্যন্তরে কোন্দল:
আতার্তুকের অনুসারীদের সিএইচপির অভ্যন্তরে অনেকটা প্রকাশ্য কোন্দল পরিলক্ষিত হচ্ছে। দলের সভাপতি কেমাল কিলিসদার সাথে দলের সহ-সভাপতি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মোহররেম ইঞ্জের দ্বন্দ। কেমাল কিলিসদা ইতিমধ্য সংসদ নির্বাচনে ইনজের পক্ষালম্বনকারী প্রায় ৬০ জন এমপিকে নমিনেশন দেয়নি যা নিয়ে এই দুই নেতা প্রকাশ্যেই তাদের জনসভাগুলোতে একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বিভিন্ন স্থানে কেমাল কিলিসদার সমর্থিত নেতারা ইয়ি পার্টির প্রধান মেরাল আকসেনারের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ উঠছে। ফলে ধারনা করা হচ্ছে সংসদ নির্বাচনে সিএইচপি ২৪-২৬% ভোট লাভের সম্ভাবনা থাকলেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মোহররেম ইনজে ২০-২২ % এর বেশি ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার স্ট্রাকচারের পরিবর্তনের ঘোষনা:
তুরষ্কের সকল ইসলামী এবং ডানপহ্নি দলগুলো ক্ষমতায় এসে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা তথা ৪+৪+৪ পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য কাজ করেছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একজন ছাত্র কোনো প্রকার শিক্ষা গ্যাপ ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাদ্রাসা (ইমাম হাতিপ) এবং হেফজ সম্পূর্ণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। ৪+৪+৪ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নাজমুদ্দিন এরবাকান ক্ষমতায় এসেই এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কাজ করেছেন। ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭ সালে ক্ষমতা থেকে সরানোর সময় ১৮ টি ধারায় তার জোড় পুর্বক স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিলো যার একটি ছিলো ৪+৪+৪ শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে কাজ না করা। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিএইচপির প্রার্থী ঘোষনা দিয়েছে তিনি ক্ষমতায় আসলে এরদোয়ানের প্রবর্তিত ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা উম্মুক্ত রাখার এই স্ট্রাকচার ভেংগে সেক্যুলারদের পুরানো স্ট্রাকচার আবার প্রবর্তন করবে।
টিকা বন্ধ ও সিরিয়ানদের বিষয়ে হুমকি:
এছাড়াও বিদেশী সাহায্য সহযোগীতা সংস্থা টিকা (TIKA) কে বন্ধের ঘোষনা দিয়েছে সিএইচপি এববং ইয়ি পার্টির প্রধান। সেই সাথে সাড়ে তিন মিলিয়ন সিরিয়ানদের তুরষ্কে থাকার বিষয়েও তারা উভয়েই হুমকি দিয়েছে।
বিদেশী শক্তির এরদোয়ান বিরোধী অবস্থান:
ইতিমধ্য ইউরোপের দুই একটি দেশ ব্যতিত সকল স্থানে এরদোয়ান তথা একে পার্টির প্রচারণা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, একই সাথে বিরোধীদল সেখানে পুলিশ প্রহরায় কাজ করছে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন অধিভুক্ত এক দেশের মন্ত্রী সিএইচপি প্রার্থীর কাছে জানতে চেয়েছে সে বিজয়ী হলে এরদোয়ানকে গ্রেফতার করবে কিনা। এভাবে বিদেশী শক্তিগুলোর এরদোয়ানের বিপরিতে অবস্থান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারন তার্কিশদের হৃদয়ে এরদোয়ানের প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। সেই সাথে বিদেশী শক্তিগুলো যে ইউরোপের পাশে শক্তিশালী তুরষ্ককে চায়না সেটাও সাধারন তুর্কিশরা অনুধাবন করে।
তুরষ্কের রাজনীতির আদর্শিক বিভাজন ওসমানীদের উত্তরসুরী এবং আতার্তুকের অনুসারীদের মধ্য বিভক্ত। এই নির্বাচনের দুইটি জোট মুলত তুরষ্কের আদর্শিক বিভাজনেরই একটি বহিঃপ্রকাশ। যদিও মুল ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টি বাম আদর্শে বিশ্বাসী সিএইচপির জোটভুক্ত এবং মেরাল আকসেনাদের অধিকাংশ সমর্থক ডানপহ্নি জাতীয়তাবাদী দল থেকে আসা। এরদোয়ান তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে এবং শক্তিশালী তুরষ্ক গঠনে আবারো ক্ষমতায় আসতে জনগনের দাড়প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। অপরদিকে বিরোধী জোট শুধুমাত্র এরদোয়ানের পরিবর্তনকে সামনে নিয়েই কাজ করছে। আগামী ২৪ জুন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে তুরষ্কের ভাগ্য; এই তুরষ্ক এরদোয়ানের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে নাকি আতার্তুকের উত্তরসুরী কেমাল কিলিসদা এববং মোহররেম ইনজেদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন