ফরহাদ মজহার
দিল্লির আগ্রাসী নীতি এবং মোদীর হিন্দুত্ববাদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। বিএনপি যদি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা মানে তাহলে মনে রাখা দরকার ১৯ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে, “সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা,অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা”।
‘সর্বতোভাবে’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যার মধ্যে গণপ্রতিরক্ষা ও সামরিক প্রস্তুতিও অন্তর্ভূক্ত। যার কারণে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী জনগণের নিরংকুশ সমর্থন পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সৈনিক ও জনগণের গণতান্ত্রিক মৈত্রীর প্রতীকও হয়ে উঠেছিলেন জিয়া। কিন্তু বিএনপি আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার এই ভাবমূর্তির তাৎপর্য আজ অবধি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয় নি। শেখ মুজিবর রহমানের বিপরীতে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক হিশাবে প্রমাণ করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করেছে, ফলে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বাঙালি জাতিবাদী রাজনীতির বয়ান ও ফাঁদের মধ্যে অনাবশ্যক বিতর্ক হয়ে পড়ে রয়েছে। রাজনীতির সুবর্ণ মূহূর্তগুলো তুলনামূলক ভাবে গৌণ ইস্যুতে ব্যয় করেছে। আজ ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচির তাৎপর্য কর্মীদের না বোঝানো এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা না করার পরিণতি হয়েছে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া এবং ফেলানির গুলি খাওয়া লাশ ঝুলে থাকা। আর এখন ভারতের থার্ড ক্লাশ থিংকট্যাংকের কাছে ধর্না দিয়ে বলা হচ্ছে অতীতে বিএনপির রাজনীতি ভুল ছিল! আফসোস, তাহলে তো ১৯ দফা সমেত জিয়াউর রহমানই ভুল ছিলেন।
জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার শেষ দফা ছিল, “ধর্ম,গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা”। যারা বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত তাঁরা জানেন বিএনপির ১৯ দফা কর্মসূচির এই দফা বুর্জোয়া গণতন্ত্রেরই সার কথা। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে এখানে বিএনপির পার্থক্য নীতিতে নয়, কৌশলে। বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে এই দফা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কিনা সেটাই হচ্ছে তর্কের বিষয়। জিয়াউর রহমান এই সীমাবদ্ধতা বুঝতেন, ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী বাম রাজনৈতিক ধারাকে তিনি বিএনপি গড়ার প্রক্রিয়ায় সঙ্গে নিয়েছিলেন। রাজনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে বিএনপিতে গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল নেতা ও চিন্তার উত্থান ঘটে। বাম গণতান্ত্রিক ধারা বিএনপি থেকে ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়। “ধর্ম,গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা” ইত্যাদি স্রেফ কাগুজে কথাবার্তায় পর্যবসিত হয়। কেউ পড়েও না, বোঝেও না।
বিএনপি কোন বিপ্লবী দল নয়, কিন্তু বুর্জোয়া দল তো বটেই। বিএনপির গণসমর্থন তার এই বুর্জোয়া কর্মসূচীর জন্যই। আর সেটা প্রণয়ণ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, যিনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েমের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার যে সমর্থন পেয়েছিলেন বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা ছিল যৌক্তিক। সমাজতন্ত্র ও জাতিবাদের মিশ্রণসহ যারা বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষী ফ্যাসিজম কায়েম করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য বিএনপির দরকার ছিল। এখনও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।
সূত্র: ফরহাদ মজহারের ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন