|
ইকতেদার আহমেদ
iktederahmed@yahoo.com |
|
মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কেন ছলচাতুরি?
22 Jun, 2014
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি অবধি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের জন্য আবশ্যক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের পর যথারীতি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ৩ মার্চ ১৯৭১ পার্লামেন্টের অধিবেশন আহবান করা হয়। অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য ঢাকায় উপস্থিতও হয়েছিলেন। অধিবেশনের আগে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সর্বাধিক ৮১ আসনে বিজয়ী পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর আলোচনা ব্যর্থ হলে ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এরপর ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম এনে সামরিক বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলাকালীন ৭ মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ও দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিলেও এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার দলের সংগ্রামকে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম বলে উল্লেখ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ২৫ মার্চ অবধি তার সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা অব্যাহত থাকলেও এ সময়ে কার্যত ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৭ মার্চের পর বিভিন্ন জেলা ও থানা শহরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে দখলদার বাহিনীর মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয় এবং এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ১৪-২২ বছর বয়সের বিপুলসংখ্যক ছাত্র অংশগ্রহণ করেন। রাজধানী ঢাকায় যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছিল, তাতে ছাত্রীদের জন্যও পৃথক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের বিপুলসংখ্যক ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ব্যর্থ হলে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করেন এবং সে রাতে তার নির্দেশনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামক এক অভিযান চালিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পক্ষের শক্তিকে নির্মূলে অবতীর্ণ হয়। মুক্তি সংগ্রামের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান বাহিনী সামরিক শক্তি দিয়ে এ দেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামকে অবদমিত করার প্রয়াস নেবে। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণের সূচনা করে, তখন তারা দেখতে পান আগে যা আঁচ করেছিলেন তা অমূলক ছিল না।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর অভিযান শুরু হলে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে পাকিস্তানি সৈন্য প্রবেশের আগ পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ ও প্রতিরোধে ছেদ পড়লেও শহরের বাইরে এবং গ্রামাঞ্চলে তা অব্যাহত থাকে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে প্রদত্ত ভোটের ৯৫ শতাংশ পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের এ ভোট প্রাপ্তির হার থেকে ধারণা পাওয়া যায়, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর দলত্যাগী সেনা, নৌ, বিমান, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস), পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ এ দেশের ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতার এক ব্যাপক অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্য ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং কিছুসংখ্যক দেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রশিক্ষিত ও নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনিয়মিত মুক্তিবাহিনী মূলত দেশপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ মাতৃভূমিকে দখলদারমুক্ত করতে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে যে রণকৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল সেটি ছিল গেরিলা যুদ্ধ। জনমানুষের সম্পৃক্ততা ও সমর্থন ছাড়া কখনও গেরিলা যুদ্ধ সফল হয় না। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ও ব্যাপক সমর্থনের কারণেই অচিরেই দেখা যায় গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পরিচালিত মুক্তি সংগ্রাম সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এ দেশের সব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিল। এমনও অনেক ঘটনা আছে- মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা এবং সহযোগিতা করার কারণে বহু লোককে হত্যা করা হয় এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার এ ধরনের লোক এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার কারণে সহায়-সম্বল হারানো লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে এ দেশের মুক্তি সংগ্রামে যে অনন্য অবদান রেখেছিলেন, তার বিনিময়ে তারা কী পেয়েছেন আজ সময় এসেছে তার হিসাব নেয়ার। এ ধরনের অসংখ্য ব্যক্তি, যারা এ দেশের সিংহভাগ মানুষ, তাদের স্বীকৃতি কোথায়? তারা কি মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছেন?
স্বাধীনতার পর ভারত ও দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু ভাগ্যবান মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী এবং আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেলেও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এমন বিপুলসংখ্যক মানুষ সনদ পায়নি অথবা মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে দেশ থেকে কিছু নেয়ার পরিবর্তে দেশকে দেয়ার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছেন এ আÍোপলব্ধি থেকে সনদ গ্রহণ হতে বিরত থাকেন।
১৯৮২ সালে এইচএম এরশাদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের আগে দেয়া সব সনদ গ্রহণপূর্বক নতুনভাবে তালিকা প্রণয়নে উদ্যোগী হন। সে সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রগ্রহণ না করেও অন্তর্ভুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও বহির্ভুক্তির যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্যও সব ধরনের সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরূপ ৩০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ রাখার বিধান প্রবর্তন করা হয়। একই সঙ্গে সে বছর মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের চাকরিতে অবসরের বয়স দুবছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয় যা পরে পুনঃ একবছর বৃদ্ধি করে ৬০ বছর নির্ধারণ করা হয়। আওয়ামী লীগের এ দুটি পদক্ষেপের কারণে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যক্তি নেমে পড়ে। এতে করে সনদ প্রদানের সঙ্গে সরকারিভাবে যারা দায়িত্বে ন্যস্ত, তাদের অনেকেরই পকেট ভারি হতে থাকে। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা সনদ সংগ্রহের জন্য বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করেছেন, আবার এরূপ অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা নিজ প্রভাব খাটিয়ে সনদ সংগ্রহ করেছেন। এ ধরনের সনদ সংগ্রহকারী অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না এবং সনদ গ্রহণকারী এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স ছিল ৬-১২ বছরের কোঠায়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় আওয়ামী ঘরানার প্রভাবশালী সচিব ও পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহের অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের টেলিভিশন ক্যামেরায় অভিব্যক্তি এবং মিডিয়া থেকে নিজেদের আড়াল করার ভঙ্গি দেখে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য। তাই এ দেশের সচেতন জনমানুষের প্রশ্ন- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের শীর্ষ পদধারী সচিবদের এবং খোদ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ যদি ভুয়া হয়, সেক্ষেত্রে অন্যদের সনদ যে খাঁটি (বেহঁরহব) তার নিশ্চয়তা কোথায়?
অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল নির্বাচনে নির্বাচিত দুজন ভাইস চেয়ারম্যানের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ভুয়া এবং নির্বাচিত একজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা তো নয়ই বরং আলবদর বাহিনীর যে সক্রিয় সদস্য ছিল, সে বিষয়ে একাধিক মামলা বর্তমানেও বিচারাধীন। এ ধরনের ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্বকারী কর্তাব্যক্তি হিসেবে অভিষিক্ত হলে তা যে মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্যকেই খাটো করবে- এ ব্যাপারে আর সন্দেহ কী!
মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি অদ্যাবধি কোনো আইনে সংজ্ঞায়িত হয়নি এবং সংজ্ঞায়িত হওয়ার অনুপস্থিতিতে কিসের ভিত্তিতে সনদ দেয়া হচ্ছে তা দেশবাসীর কাছে বোধগম্য নয়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি করে ইতিমধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদসহ অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এসব কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় এনে সাজা দেয়া না গেলে আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রাম কালিমালিপ্ত হয়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সিংহভাগ স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তারা ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আর তাই একান্তই যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দিতে হয়, তাহলে সে সনদের প্রথম হক্দার এ দেশের জনমানুষ, যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ব্যাপক সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও আজ কতিপয় ভাগ্যবান, যাদের অনেকেই অপকৌশল ও ছলচাতুরির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেটধারী, তারা মুক্তি সংগ্রামকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মুক্তি সংগ্রামকে এভাবে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দেয়া এ দেশের জনমানুষের জন্য অপমানজনক, যাদের অনন্য ত্যাগ ছাড়া এ দেশের মুক্তি সংগ্রাম সফল হওয়া সম্ভব হতো না।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন